১২ জানুয়ারি বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণের পরে অন্যতম পার্বণ স্বামী বিবেকানন্দের পবিত্র জন্মদিন।
বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত (ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন)।১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের এক পবিত্র দিনে উত্তর কলকাতার সিমলা পল্লীর ৩ নং গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী। তিনি ছিলেন তার নয় ভাই-বোনের অন্যতম। তাঁর মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গী। কনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।
৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা শ্রীপাদ_শংকরাচার্যই প্রথম হিন্দুজাতির রক্ষার্থে সংগঠনের ধারণা এবং আধুনিক যুগে সংগঠন বলতে আমরা যা বুঝি তা তৈরি করেন। সনাতন ধর্ম রক্ষার্থে তিনি সাংগঠনিক প্রয়োজনে ভারতবর্ষকে পূর্ব,পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ - এ চারভাগে বিভক্ত করে এ চারভাগকে দেখাশুনার জন্যে তাঁর চার প্রধান শিষ্য পদ্মপাদ,হস্তামলক,তোটকাচার্য এবং সুরেশ্বর এ চার প্রধান শিষ্যকে দায়িত্ব দেন। শ্রীপাদ শংকরাচার্যের হাতে জন্ম নেয়া হিন্দু সংগঠন এবং ভারতীয় বৈদান্তিক আধ্যাত্মবাদ কিভাবে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাবে সে পথ আমাদের দেখান স্বামী বিবেকানন্দ।
স্বামীজী ছিলেন প্রাচীন এবং বর্ত্তমান ; ভারতবর্ষীয় এবং পাশ্চাত্ত্যের সফল যোগসূত্রকারী। তাঁর পূর্বেও কয়েকজন বাঙালীর সন্তান প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এবং মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় গিয়েছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ প্রচারে ; কিন্তু তাঁরা তেমন সফলতা বা সাড়া পাননি। কিন্তু স্বামীজী তাঁর পাণ্ডিত্য এবং বিদগ্ধতায় এলেন, দেখলেন এবং জয় করে নিলেন পাশ্চাত্য -আমেরিকানদের হৃদয়। তাঁর পরবর্তী ধারাক্রমে পাশ্চাত্য -আমেরিকায় ধর্মপ্রচারে যাঁরা অনন্য অবদান রাখেন তাঁরা হলেন-
- স্বামী সারদানন্দ
- স্বামী অভেদানন্দ
- স্বামী তুরিয়ানন্দ
- স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ
- পরমহংস যোগানন্দ
- মহানামব্রত ব্রহ্মচারী
- শ্রীচিন্ময়
- অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী
( প্রচারের সন অনুসারে বিবেকানন্দ পরবর্তী এই আটজনের তালিকা সাজানো হল)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকার সময় একটি গান প্রায়ই গাইতাম স্বামী বিবেকানন্দকে উপলক্ষ করে :
তখন এই গানটির অর্থ খুব একটা বুঝতে পারিনি। আজ বুঝতে পারছি কতো গভীরতম প্রদেশে বিস্তৃত এর অর্থ!
বেদের বিভিন্ন স্থানে সংগঠনের কথা আছে। এমনকি বেদের বহুল প্রচলিত 'সংজ্ঞান' সূক্তের মধ্যেও সংগঠন বাচক 'সমিতি' শব্দটি আছে। কিন্তু আধুনিক যুগে হিন্দুজাতির প্রথম সংগঠন তৈরি করেন শ্রীপাদ শঙ্করাচার্য।তার দেখানো পথে পরবর্তীকালে রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য,নিম্বাকাচার্য, আচার্য রামানন্দ, শ্রীচৈতন্যদেব, শঙ্করদেব প্রমুখ আচার্যবৃন্দ জাতি রক্ষার্থে অগ্রণী সাংগঠনিক ভূমিকা গ্রহণ করেন।
এরপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্ষমতায় আসে বেনিয়া ব্রিটিশ শক্তি। তারা পূর্ববর্তী পাঠান এবং তুর্কিদের ন্যায় অসভ্যতা পরিত্যাগ করে গ্রহণ করে অন্য কৌশল। ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তারা সংঘবদ্ধ মিথ্যা প্রচারণা করতে থাকে। ফলে ভারতবর্ষের শিক্ষিত যুবকদের মাঝে নিজ ধর্ম এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে এক তীব্র নেতিবাচক মানসিকতার তৈরি হয়। পরিণতিতে হিন্দুজাতি হারায় মাইকেল মধুসূদনের মতো তার অসংখ্য কীর্তিমান শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
এমনই পরিবেশে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম হয় স্বামী বিবেকানন্দের। তিনিই বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তী ব্রিটিশের মিথ্যা প্রচারণার সার্থক দাঁতভাঙা জবাব দেন। এবং আমাদের শেখালেন এক অমোঘ তেজস্বী বাক্য : "গর্ব করে বলো আমি হিন্দু।" বেদান্তের জ্ঞানকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় জ্ঞানের দুয়ারকে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্যে খুলে দেন এবং শ্রীশঙ্করাচার্য হিন্দুজাতির ইতিহাসে ধর্মসঙ্ঘ বা সংগঠন প্রথম তৈরি করেন ; সেই ধর্মসঙ্ঘকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার দুয়ার খুলে দেন স্বামী বিবেকানন্দ। এ কারণেই তিনি অনন্য। আমাদের চিন্তানায়ক। চেতনার বাতিঘর।
সর্বধর্মের নামে গোজামিল দেয়া, আত্মঘাতী স্বজাতি ধ্বংসের তেলবাজির বিরুদ্ধে বেদান্ত সম্পর্কে তাঁর অনন্য উক্তি আমাদের অবহেলিত হিন্দু জাতিকে আজও পথ দেখায়-
"পৃথিবীর সকলেরই বেদান্তের চর্চা করা কেন উচিত, তাহার প্রথম কারণ এই যে, বেদান্তই একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম। দ্বিতীয় কারণ, জগতে যত শাস্ত্র আছে, তন্মধ্যে কেবল বেদান্তের উপদেশের সহিত বহিঃপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে লব্ধ জ্ঞানের পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে।"
( স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা, ৫ম খণ্ড; পৃষ্ঠা -৫৬)
"আমরা জানি বা নাই জানি- বেদান্তই আমাদের জীবন, বেদান্তই আমাদের প্রাণ, আমরণ আমরা বেদান্তের উপাসক; আর প্রত্যেক হিন্দু বেদান্তেরই সাধন করে।"
( ভারতে বিবেকানন্দ ; চতুর্দশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা -১৭৬)
স্বামী বিবেকানন্দ হলেন আধুনিক ভারতবর্ষের আইকন, আধুনিক হিন্দুজাতির আইকন। আজ আমরা প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে যে চিন্তার কাঠামো তৈরি করি তার অন্যতম কারিগর এবং চিন্তাসূত্রকার তিনি। নেতাজী সুভাষ বসু থেকে সকল বিপ্লবীদের প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন তিনি। তরুণ এবং যুবসম্প্রদায়ের জাগরণে তাঁর অবদান অনন্যসাধারণ। তাইতো তাঁর জন্মদিন ভারতে যুবদিবস হিসেবে পালিত। সেই ভারতবর্ষীয় অধ্যাত্মবাদ প্রচারের বীরসেনাপতি, চিন্তানায়ক, যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইলো অনন্ত শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী