১৫৩৩ সালের ২৯ জুন গান গাইতে গাইতে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ঢুকে ছিলেন পুরীর মন্দিরে৷ তারপর…… তারপর আর নেই ৷ এরপর আর কেউ নাকি মহাপ্রভুর দেখা পাননি ৷ তিনি বিলীন হলেন কোথায়? গৌরাঙ্গকে ঘিরে সেটাই তো রহস্য ৷
অনেকের ধারণা, ওই দিনই মাত্র ৪৮ বছর বয়েসে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর ৷ কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, ওই দিনটিতেই কি তিনি খুন হন? আবার অনেকে তাঁর মৃত্যুর বদলে ‘অন্তর্ধান’ শব্দটাই ব্যবহার করতে চান, কারণ মহাপ্রভু তো সেই দিনটির পর থেকেই হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ কেউ তো তাঁকে আর কখনও দেখতে পায়নি ৷ সেক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যু অথবা অন্তর্ধান ঘিরে একটা অজানা ‘রহস্য’ বা ‘মিথ’, যাই বলি না কেন কাজ করেছে ৷ আশ্চর্যের কথা, ওই সময় থেকে সাড়ে চারশো বছর পরে সেই রহস্যই ভেদ করতে গিয়ে “কঁহা গেলে তোমা পাই” নামক চৈতন্য অনুসন্ধানী গ্রন্থের লেখক জয়দেব মুখোপাধ্যায়ও ১৯৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল অস্বাভাবিকভাবে মারা যান ৷ অন্তর্তদন্ত বলছে, জয়দেববাবুও নিহত হন। শ্রীচৈতন্য এবং জয়দেব মুখোপাধ্যায় দুই জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুই আসলে খুন বলে দাবি করছে দু’টি প্রবন্ধ ৷ একটি সম্প্রতি লেখা, অন্যটি বেশ কয়েক বছর আগের ৷
সম্প্রতি সপ্তডিঙা-জুন ২০১৬ সংখ্যায় তমাল দাশগুপ্ত লিখেছেন ‘চৈতন্য হত্যার অনুসন্ধানে’ নামে প্রবন্ধটি৷ অন্যটি বেশ কয়েক বছর আগের ৷ শারদীয়া আজকালে ‘চৈতন্য খুনের কিনারা করতে গিয়ে খুন’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধ লিখেছিলেন অরূপ বসু ৷ শ্রীচৈতন্যেকে ঘিরে মিথ অনেক রকম ৷ যেমন, বর্তমানে পুরীর নীলাচল নামে যে অঞ্চল পরিচিত সেখানেই কৃষ্ণনাম জপতে জপতে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলে যান আর সেই পথেই বিলীন হন মহাপ্রভু । তারপর থেকেই ওই অঞ্চলের নাম নীলাচল। আবার শোনা যায় চৈতন্যদেব নাকি জগন্নাথের মূর্তিতে লীন হয়েছিলেন৷ আবার কেউ কেউ বলেন, নগর সংকীর্তনে বের হয়ে পথে তাঁর পায়ে ইটের আঘাত লেগেছিল৷ তার থেকেই সেপটিসিমিয়া, এবং মৃত্যু ৷ যদিও মন্তান্তরে বলা হয়ে থাকে ইটের টুকরো নয়, পায়ে কাঠি ঢুকে যাওয়াতেই সেপটিসিমিয়া, আর তার জেরে মৃত্যু ৷ কৃষ্ণের সঙ্গে মহাপ্রভুকে মিলিয়ে দিতে দুজনের মৃত্যুতেও মিল টানার একটা অভিপ্রায় রয়েছে এমন মিথ্যের পেছনে ৷ কারণ মহাভারতে ব্যাধের ছোঁড়া তীর লেগেছিল কৃষ্ণের পায়ে আর তার থেকেই মৃত্যু হয়েছিল যশোদা-নন্দনের ৷
কিন্তু উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধই ইঙ্গিত দিয়েছে, শ্রীচৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সেটা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের তৎকালীন পাণ্ডারা করেছিল৷ প্রবন্ধকারদ্বয়ের যুক্তি, ঈর্ষাবশত পুরীর পাণ্ডারা চৈতন্যকে হত্যা করেন গুণ্ডিচা মন্দিরের গরুড় স্তম্ভের তলায়। তার পর তাঁর নশ্বর দেহ মন্দিরেই পুঁতে দেওয়া হয় ৷ আর এই সত্য জানতে পারায় পরবর্তীকালে গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়কেও হত্যা করা হয়। প্রসঙ্গত স্বর্গদ্বারে এখন যে চৈতন্যমূর্তিটি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাও জয়দেববাবুর উদ্যোগেই বসানো হয়েছিল ৷ শ্রীচৈতন্যের সংস্পর্শে কলিঙ্গের সেই সময়কার রাজা প্রতাপরুদ্র এতটাই আবিষ্ট হয়ে যান যে, তাঁর ওপর পুরীর পাণ্ডাদের প্রভাব কমে আসে ৷ মহাপ্রভুর মহিমায় রাজা ক্রমশ যুদ্ধবিরোধী হয়ে পড়ায় যুদ্ধবাজ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম বিক্রেতারাও অসুবিধায় পড়েছিল৷ তাছাড়া কালকূটের (সমরেশ বসু) ‘জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য’ উপন্যাসেও চৈতন্য হত্যার প্রসঙ্গ এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন তমালবাবু ৷
তিনি প্রবন্ধটিতে আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন, চৈতন্য হত্যা নিয়ে মালীবুড়ো (যুধিষ্ঠির জানা) “চৈতন্য অন্তর্ধান রহস্য” নামে একটা বই লিখেছেন৷ তাছাড়া আর বেশ কিছু গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিতে দেখা গিয়েছে নিজ যুক্তির সমর্থনে ৷ অন্যদিকে, অরূপ বসুর প্রবন্ধটিতে প্রশ্ন তোলা হয়, জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হল? তাঁর অন্তর্তদন্তে ইঙ্গিত, ওই গবেষক পুরীতে খুনই হয়েছিলেন ৷ সেক্ষেত্রে তড়িঘড়ি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে পুরো কেসটাই ধামাচাপা দিয়ে দেয় ওড়িশা পুলিশ ৷
আরও প্রশ্ন উঠছে এ কারণেই যে, প্রথমে সংবাদ মাধ্যমে গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর বের হলেও পরবর্তী সময়ে সেই খবরের কোনও ফলো-আপ দেখা গেল না কেন? “কঁহা গেলে তোমা পাই” গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড বের হলেও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের আগেই মারা যান জয়দেববাবু ৷ যদিও দ্বিতীয় খণ্ডের রসদ জোগাড় হয়ে গিয়েছিল তাঁর ৷ অরূপবাবুর প্রবন্ধ থেকেই জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ৫ আগস্ট চৈতন্য গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে পাঠানো একটি চিঠিতে ডঃ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছিলেন, “চৈতন্যদেবকে গুম খুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোনও অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল।…এই বয়সে শহীদ হওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই বলতে পারবো না, ঠিক কোথায় চৈতন্যকে খুন করা হয়েছিল।” আর নীহাররঞ্জন রায় যেটা বলতে চাননি, সেটা হল– জগন্নাথধামের মন্দিরের ভেতরেই চৈতন্যদেবকে হত্যা করা হয়েছিল এবং খুন করেছিল উড়ে পাণ্ডারাই। খোলাখুলি এমন বার্তাই দিয়েছিলেন সাহসী দুই প্রাবন্ধিক ।।
সংগৃহীত
মেইন পোস্ট : প্রণব কুমার কুণ্ড