ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যাঁদের হাত ধরে গণিতের বিকাশ হয়েছে।
এক নজরে ব্রহ্মগুপ্তের জীবন
তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। ধারণা করা হয় ব্রহ্মগুপ্ত ৫৯৮ সালে ভারতের উত্তর পশ্চিমের রাজস্থানের ভিনমাল (তৎকালীন ভিল্লামালা) নামক শহরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল জিষ্ণুগুপ্ত। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান ভিল্লামালায়, রাজা ভ্যাগ্রমুখের রাজত্বকালে। ধারণা করা হয় তিনি রাজার অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। অনেক সময় তাঁকে ভিল্লামাচারিয়া (ভিল্লামার শিক্ষক) বলে ডাকা হত। তিনি উজ্জাইনের মানমন্দিরের প্রধান ছিলেন। ৬৬৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্রহ্মগুপ্তের অবদান
উজ্জাইনের মানমন্দিরের প্রধান থাকাকালীন ব্রহ্মগুপ্ত গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার উপর চারটি বই লেখেন। এই বইগুলো হল চাদামেকেলা, ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত, খণ্ডখদ্যকা এবং দুরকেয়াম্যনাদ্রা। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত (ব্রহ্মর সংশোধিত নীতিমালা)। ইতিহাসবিদ আবু রায়হান আল বিরুনী (৯৭৩ - ১০৪৮) তাঁর বই তারিখ আল হিন্দ (ভারতীয় ইতিহাস) এ উল্লেখ করেন,
আব্বাসীয় খলিফা আল মামুনের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ভারতবর্ষ থেকে একটি বই আরবে নিয়ে আসেন এবং তা আরবিতে অনুবাদ করেন সিন্দহিন্দ নামে।
ধারণা করা হয় এ বইটি ছিলো ব্রহ্মগুপ্তের লেখা ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত। তিনি বিখ্যাত ভারতীয় জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ও গণিতজ্ঞ ভাষ্করের কাজ সম্পর্কে জানতেন। তিনি তাঁর সমকলীন জ্যোতির্বিদদের ভুল বের করার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তাঁর বই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে মোট ২৪ টি চ্যাপ্টার লেখেন, যার মধ্যে শেষের ১৪ টি কে আসলে প্রথম ১০ টির এক্সটেনশন বলা যেতে পারে। চ্যাপ্টারগুলো এরকম:
১। গ্রহসমূহের গড় কোঅর্ডিনেট
২। গ্রহসমূহের আসল কোঅর্ডিনেট
৩। আন্হিক গতির উপর তিনটি সমস্যা
৪। চন্দ্রগ্রহণ
৫। সূর্যগ্রহণ
৬। উদয়াস্ত
৭। চাঁদের অর্ধাকৃতি
৮। চাঁদের ছায়া
৯। গ্রহসমূহের সংযোগ
১০। গ্রহসমূহের সাথে স্থির নক্ষত্রের সংযোগ
১১। পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিদ্যার উপর পরীক্ষণ
১২। পূর্ববর্তী গণিতের উপর পরীক্ষণ
১৩। চ্যাপ্টার ১ এর এক্সটেনশন
১৪। চ্যাপ্টার ২ এর এক্সটেনশন
১৫। চ্যাপ্টার ৩ এর এক্সটেনশন
১৬। চ্যাপ্টার ৪ ও ৫ এর এক্সটেনশন
১৭। চ্যাপ্টার ৭ এর এক্সটেনশন
১৮। বীজগণিত
১৯। উন্মোচনকারী
২০। পরিমাপ
২১। গোলক
২২। যন্ত্র
২৩। সূচিপত্র
২৪। ছক
উল্লেখ্য যে, তাঁর লেখা ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত বইয়ে তিনি ছড়ার মাধ্যমে গণিতের বিভিন্ন তত্ত্ব বর্ণনা করেন। এটা আসলে তত্কালীন ভারতীয় রীতি ছিলো। তিনি তাঁর এ তত্ত্বগুলো কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন, সে সম্পর্কে অবশ্য কিছু জানা যায়নি।
ব্রহ্মগুপ্ত ও গণিত
ব্রহ্মগুপ্তের প্রধাণ ও সবচেয়ে অসাধারণ আবিষ্কার ০। তিনি সবার প্রথম ০ এর সংজ্ঞা দেন এভাবে যে, কোনো সংখ্যাকে তার নিজের থেকে বিয়োগ করলে ০ পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, কোনো সংখ্যার সাথে ০ যোগ করলে ঐ সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না এবং কোনো সংখ্যাকে ০ দিয়ে গুণ করলে ০ পাওয়া যায়। ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথম বইগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে পজিটিভ নাম্বার, নেগেটিভ নাম্বার ও ০ নিয়ে সুস্পষ্ট আলোচনা পাওয়া যায়। এর আগে ব্যাবিলোনিয়ান ও রোমান গণিতবিদগণ ০ কে কোনো আলাদা ডিজিট হিসাবে বিবেচনা করতেন না। ব্রহ্মগুপ্তই প্রথম সবাইকে আলাদা ডিজিট হিসাবে ০ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর এ বইয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো দেন, তা এরকম:
১। দুটো পজিটিভ নাম্বারের যোগফল পজিটিভ।
২। দুটো নেগেটিভ নাম্বারের যোগফল নেগেটিভ।
৩। ০ ও একটি নেগেটিভ নাম্বারের যোগফল নেগেটিভ।
৪। ০ ও একটি পজিটিভ নাম্বারের যোগফল পজিটিভ।
৫। ০ ও ০ এর যোগফল ০।
৬। দুটো পজিটিভ ও নেগেটিভ নাম্বারের যোগফল আসলে তাদের বিয়োগফল। আর যদি তারা সমান হয়, তাহলে যোগফল ০।
৭। দুটো পজিটিভ নাম্বারের বিয়োগের ক্ষেত্রে বড় থেকে ছোট বাদ দিতে হবে।
৮। দুটো নেগেটিভ নাম্বারের বিয়োগের ক্ষেত্রে বড় থেকে ছোট বাদ দিতে হবে।
৯। যদি ছোট থেকে বড় নাম্বার বিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে বিয়োগফল উল্টে যাবে।
১০। যদি নেগেটিভ নাম্বার থেকে পজিটিভ নাম্বার বিযোগ করতে হয় বা পজিটিভ নাম্বার থেকে নেগেটিভ নাম্বার বিয়োগ করতে হয়, তাহলে আসলে তাদের যোগ করতে হবে।
১১। একটি নেগেটিভ ও একটি পজিটিভ নাম্বারের গুনফল নেগেটিভ।
১২। দুটো নেগেটিভ নাম্বারের গুনফল পজিটিভ।
১৩। দুটো পজিটিভ নাম্বারের গুনফল পজিটিভ।
১৪। দুটো পজিটিভ নাম্বারের ভাগফল এবং দুটো নেগেটিভ নাম্বারের ভাগফল উভয়ই পজিটিভ।
১৫। পজিটিভ নাম্বারকে নেগেটিভ নাম্বার দিয়ে ভাগ করলে নেগেটিভ পাওয়া যাবে, আবার নেগেটিভকে পজিটিভ দিয়ে ভাগ দিলেও নেগেটিভ পাওয়া যাবে।
১৬। পজিটিভ বা নেগেটিভ নাম্বারকে ০ দিয়ে ভাগ করলে ০ হর বিশিষ্ট ভগ্নাংশ পাওয়া যাবে।
১৭। ০ কে পজিটিভ বা নেগেটিভ দিয়ে ভাগ করলে ০ ই পাওয়া যাবে, অথবা ০ লব বিশিষ্ট ভগ্নাংশ পাওয়া যাবে।
১৮। ০ কে ০ দিয়ে ভাগ করলে ০ পাওয়া যাবে।
পূর্বে অনেক সভ্যতায় গণিতের বেসিক চারটা অপারেশন (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) পরিচিত থাকলেও, আমরা এখন যেভাবে এই অপারেশনগুলো করি, তা মূলত আরব-ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতির আবিষ্কার, যা প্রথম পাওয়া যায় ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে। অবশ্য ভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী সুমেরীয়রা পদ্ধতিগুলো প্রথম আবিষ্কার করে প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তে গুণকে বলা হয়েছে গোমূত্রিকা। বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ের গণনা নামক অনুচ্ছেদে ব্রহ্মগুপ্ত ভগ্নাংশের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন। এখানে তিনি বর্গ, বর্গমূল, ঘণ ও ঘণমূল নিয়েও আলোচনা করেন।
ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর বইয়ের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (বীজগণিত) লিনিয়ার ইকুয়েশনের (একমাত্রিক সমীকরণ) সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি এই চ্যাপ্টারের শেষের দিকে দ্বিঘাত সমীকরণেরও দুটো সমাধান দেন, যদিও এ সমাধানের সাথে বর্তমান সময়কার সমাধানের কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর বইয়ে যে নোটেশনগুলো ব্যবহার করেন, তা বেশ মজার। এগুলো এরকম:
১। দুটো সংখ্যাকে পাশাপাশি লিখে যোগ বোঝানো হয়।
২। যদি কোনো সংখ্যাকে আরেকটি সংখ্যা থেকে বিয়োগ করতে হয়, তাহলে সেই সংখ্যার মাথায় একটা ফোঁটা বা ডট দিতে হবে।
৩। ভাগের ক্ষেত্রে ভাজ্যের নিচে ভাজককে লেখতে হবে। এটা বর্তমান সময়ের 'বাই' এর মতো, শুধু মাঝের হরাইজন্টাল লাইনটা ছাড়া।
ব্রহ্মগুপ্ত দশের বর্গমূলকে পাই এর আসল মান এবং ৩ কে এর ব্যবহারিক মান বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি সাইন ফাংশন, ইন্টারপোলেশন, ধারার যোগফল ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন।
ব্রহ্মগুপ্তের সূত্র
ব্রহ্মগুপ্ত অন্তঃবৃত্তস্থ চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফল বের করার একটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যা সাধারণ ভাবে ব্রহ্মগুপ্তের সূত্র নামে পরিচিত। যারা সাইন্সের ছাত্র, তারা সবাই এই সূত্রটি ম্যাট্রিক বা ইন্টারে পড়েছি। এই সূত্র অনুযায়ী, কোনো অন্তঃবৃত্তস্থ চতুর্ভুজের ক্ষেত্রফল:
এখানে,
s = চতুর্ভুজের পরিসীমার অর্ধেক (চার বাহুর দৈর্ঘ্যের যোগফলের অর্ধেক)
এবং a, b, c ও d চতুর্ভুজের চারটি বাহুর দৈর্ঘ্য।
ব্রহ্মগুপ্তের উপপাদ্য
ব্রহ্মগুপ্তের অসাধারণ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই উপপাদ্য, যা এরূপ:
যদি কোনো অন্তঃবৃত্তস্থ চতুর্ভুজের কর্ণদ্বয় পরস্পর লম্বভাবে অবস্থিত হয়, তাহলে কর্ণদ্বয়ের ছেদবিন্দু হতে কোনো বাহুর উপর অঙ্কিত লম্বের বর্ধিতাংশ বিপরীত বাহুকে সমদ্বিখণ্ডিত করে।
চিত্র: ব্রহ্মগুপ্তের উপপাদ্য |
চিত্রে, যেহেতু অন্তঃবৃত্তস্থ চতুর্ভুজ ABCD এর AC ও BD কর্ণদ্বয় পরস্পরের উপর লম্ব, কাজেই তাদের ছেদবিন্দু M থেকে BC এর উপর অঙ্কিত লম্ব ME এর বর্ধিতাংশ AD কে F বিন্দুতে সমদ্বিখন্ডিত করে।
ব্রহ্মগুপ্ত ও জ্যোতির্বিদ্যা
আরব জ্যোতির্বিদগণ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে যা জেনেছেন, তার বেশিরভাগই ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের মাধ্যমে। আব্বাসীয় বংশের দ্বিতীয় খলিফা আল মনসুর (শাসনকাল ৭৫৪ - ৭৭৫) তাইগ্রিসের তীরে বাগদাদ নগরীর পত্তন করেন, এবং একে জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলেন। ৭৭০ সালে তিনি উজ্জাইন থেকে কংকা নামের এক ভারতীয় পণ্ডিতকে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানান, যিনি ব্রহ্মস্ফুতসিদ্ধান্তের সাহায্যে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার ভারতীয় পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। গণিতজ্ঞ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ মুহাম্মাদ আল ফাজারী খলিফার নির্দেশে ব্রহ্মগুপ্তের লেখা আরবিতে অনুবাদ করেন।
পূর্বে ভাবা হত পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের চেয়ে বেশি। ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়ে (চাঁদের অর্ধাকৃতি) এই ভুল ধারণা খণ্ডন করেন। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর আরো যেসব গবেষণা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সময়ের সাথে নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের পদ্ধতি, নক্ষত্রের উদয় ও অস্ত সম্পর্কিত গবেষণা এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত গণনা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী পৃথিবীকে সমতল ভাবা হত, যার বিরোধিতা করেন ব্রহ্মগুপ্ত। তিনি বলেন পৃথিবী ও স্বর্গ গোলাকার এবং পৃথিবী নড়ছে। আল বিরুনী তাঁর তারিখ আল হিন্দ (ভারতের ইতিহাস) বইয়ে উল্লেখ করেন যে, তত্কালীন অনেকেই ব্রহ্মগুপ্তের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন এই বলে যে পৃথিবী যদি গোলাকার হত, তাহলে তার থেকে গাছপালা, পাথর পড়ে যেতো। ব্রহ্মগুপ্ত এসব ধারণাও খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, "ভারি বস্তুসমূহ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়। পানির ধর্ম যেমন গড়িয়ে যাওয়া, আগুনের ধর্ম যেমন জ্বলা, বাতাসের ধর্ম যেমন বয়ে চলা, তেমনি পৃথিবীর ধর্ম বস্তুসমূহকে আকর্ষণ করা ও ধরে রাখা। এ কারণেই ভারি বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে তা নিচে পড়ে যায়।" এভাবেই তিনিই প্রথম অভিকর্ষের ধারণা দেন।
কয়েকদিন আগে গণিতবিদ মূসা আল খোয়ারিজমীর উপর আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। শেষ কথা হিসাবে ঐ পোস্টে যা বলেছিলাম, তাই আবার পুনরাবৃত্তি করতে চাই। যেসব বিজ্ঞানীদের নাম আমরা অহরহ শুনে থাকি, শুধু তাঁদের শ্রদ্ধা করলেই আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞান পূর্ণতা পাবে না। বরং সম্মান করতে হবে সেসব বিজ্ঞানীদের, আলোচনা করতে হবে তাঁদের সম্পর্কেও, যাঁদের হাত ধরে জ্ঞান বিজ্ঞানের শুরু।
তথ্যসূত্র:
১। উইকিপিডিয়া
২। ম্যাকটিউটর