জাতপাত নিয়ে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ শ্রীমৎভগবতগীতায় বলেছেন,চতুর্বনংময়া সৃষ্টং গুণ কর্ম বিভাগশ’ অর্থাত্ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চারটি বর্ণ সৃষ্টি করা হয়েছে।যারা ভালো কাজ করবে ও জ্ঞানী তারা উঁচু জাত ও যারা খারাপ কাজ করবে তারা নীচু জাত।সুতরাং জাতপাত জন্ম নয়, কর্ম অনুসারে।
আসুন এবার দেখি সনাতন সমাজে বহুল প্রচলিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সম্পর্কে আমাদের পবিত্র ‘বেদ’ এ কি আছে—
ঋগবেদ ১.১১৩.৬
"একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে(ব্রাক্ষ্মন) ,অপরজন বীরত্বের গৌরবে(ক্ষত্রিয়) , একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে(পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে(শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।
ঋগবেদ ৯.১১২.১
একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাক্ষ্মন কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বেশ্য কেউ শূদ্র।
ব্রাক্ষ্মন কে?
ঋগবেদ ৭.১০৩.৮
যে ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত, অহিংস,সত্,নিষ্ঠাবান, সুশৃঙ্খল,বেদ প্রচারকারী, বেদ জ্ঞানী সে ব্রাক্ষ্মন।
ক্ষত্রিয় কে?
ঋগবেদ ১০.৬৬.৮
দৃড়ভাবে আচার পালনকারী, সত্ক৮র্মের দ্বারা শূদ্ধ, রাজনৈতিক জ্ঞান সম্পন্ন,অহিংস,ঈশ্বর সাধক,সত্যের ধারক ন্যায়পরায়ন,বিদ্বেষমুক্ত ধর্মযোদ্ধা,অসত্ এর বিনাশকারী সে ক্ষত্রিয়।
বৈশ্য কে?
অথর্ববেদ ৩.১৫.১
দক্ষ ব্যবসায়ী দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী।
শূদ্র কে?
ঋগবেদ ১০.৯৪.১১
যে অদম্য,পরিশ্রমী, ¬ অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা,লোভমুক্ত ¬ কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।
এছাড়াও,রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।
ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।
বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।
বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।
ঋষি বিশ্বামিত্র অব্রাক্ষণ হিসেবে জন্ম নিলেও পরে কর্ম ও জ্ঞান দিয়ে ব্রাক্ষণ হন,এছাড়া শ্রী রাম কথিত শর্বরীকে নবধারা ভক্তি জ্ঞান দিয়েছেন,ভক্ত রবিদাসকে অপমান করায় স্বর্গের ঘন্টাপর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়,ভগবান ভক্তের জাতপাত দেখেন না,দেখেন কর্ম ও ভক্তি।
অনেকে হয়তো বলবেন নীচুজাতদের নিয়ে অনেক কিছু বলা আছে।
কিন্তু দাদা,গীতায় বলা আছে জন্ম নয় কর্ম অনুযায়ী জাতপাত।মানে ভালো কর্ম উঁচু জাত ও খারপ কাজ করলে নীচু জাত।
খারপ কাজ করলে শাস্তির কথা তো সবখানেই আছে,এমনকি দেশের সংবিধানেও।
তাই আসুন জন্ম অনুসারে নয়,কর্ম অনুসারে জাপাত হয় এটাকে মানি।প্রচলিত জাতপাত প্রথাকে বিলুপ্ত করি।
প্রথমেই বলে নিই, হিন্দু সমাজে চারটি বর্ণ প্রচলিত আছে। যথাঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র। আমরা মনে করি যে, একজন ব্রাহ্মণের পুত্রই ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়ের পুত্রই ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের পুত্রই বৈশ্য, শূদ্রের পুত্রই শূদ্র। আসলে ঘটনাটি সঠিক নয়।
এই সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ব্রাহ্মণ কি, ক্ষত্রিয় কি, বৈশ্য কি এবং শূদ্র কি ?
ব্রাহ্মণ :- ব্রহ্মজ্ঞানে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি সত্ত্বঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
ক্ষত্রিয় :- শাসক বা যোদ্ধা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
বৈশ্য :- ব্যবসায় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ ও তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
শূদ্র :- শ্রমজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন শূদ্র, যিনি তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
ক্ষত্রিয় :- শাসক বা যোদ্ধা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
বৈশ্য :- ব্যবসায় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ ও তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
শূদ্র :- শ্রমজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন শূদ্র, যিনি তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা তপস্যা করেন, ক্ষত্রিয়রা শাসন ও যুদ্ধ করেন, বৈশ্যরা ব্যবসায় করেন এবং শূদ্ররা শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে । আমরা এর মাধ্যমে বুঝতে পারছি যে, যে যেরকম কর্ম করবে, সে সেই উল্লিখিত বর্ণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ একজন শূদ্রের পূত্র যদি ব্রহ্মজ্ঞানে দীক্ষিত হয় তাহলে সে ব্রাহ্মণ হবে এবং ঠিক এভাবেই একজন ব্রাহ্মণের পুত্র যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র হবে। এইযে বর্ণবিভাজন-এটা কিন্তু জন্মভেদে নয় কর্মভেদে।
বর্ণপ্রথা সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আরো বিশ্লেষণ করেছেন :-
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ
তস্য কর্তারমপিমাং বিদ্ব্যকর্তারসব্যয়ম (৪/১৩)
অর্থাৎ,ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন আমি চার বর্ণের রচনা করেছি। কিন্তু আমি মানুষকে চারটি শ্রেণিতে বিভাগ করিনি। গুণের আধারে কর্মকে চারভাগে বিভক্ত করেছি। গুণ এখানে মানদন্ড। কর্ম একটাই-নিয়ত কর্ম, আরাধনা। অবস্থাভেদে এই কর্মকেই উঁচুনিচু শ্রেণিতে বিভাগ করা হয়েছে। সুতরাং ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই যে ব্রাহ্মণ হবে এমনটি নয়। কোন শূদ্রের সন্তানও ব্রাহ্মণ হতে পারে। আবার শূদ্রের সন্তান যে শূদ্র হবে এমনটি নয়। কোন ব্রাহ্মণের সন্তান যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে নিজ নিজ কর্মের উপর।
কিন্তু কালক্রমে এই বর্ণপ্রথা জন্মগত হয়ে দাঁড়ায়, যেমন – ব্রাহ্মণের সন্তান হয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের সন্তান হয় ক্ষত্রিয়, অনুরূপভাবে বৈশ্য, শূদ্র জন্মগত অধিকারে পরিচিত হয়। এর ফলে দেখা গেল একই পরিবারের চার সন্তান চার রকম গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু জন্মগত কর্মবিভাজনে তাদের চারজনকে একই কর্ম করতে হচ্ছে। ফলে কর্মের দক্ষতা এরা দেখাতে পারছে না। বর্ণভেদ পেশাগত ; অবশ্যই জন্মগত নয়। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, একজন ঋষি বলছেন, আমি বেদমন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি, আমার কন্যা যব ভেজে ছাতু বানিয়ে বিক্রি করে এবং আমার ছেলে চিকিৎসক। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বর্ণভেদ বংশানুক্রমিক ছিল না। যদি বংশানুক্রমিক থাকত তাহলে তার কন্যা ও পুত্র আলাদা কর্ম করত না।
আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে বিশ্বামিত্র। যিনি একজন ক্ষত্রিয়ের রাজপুত্র ছিলেন এবং তিনি তপস্যার বলে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া বৈশ্য থেকে ব্রাহ্মণ হওয়ার উদাহরণও আমাদের সনাতন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ গুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু একালেও বংশের ভিত্তিতে বর্ণ নির্ধারিত হচ্ছে। এ-বংশানুক্রমিক বর্ণভেদ প্রথা হিন্দুধর্মাবলম্বী একত্বের জন্য প্রতিবন্ধক এবং ভ্রাতত্বের বন্ধনের প্রতিকূল। সমাজ পরিবর্তনশীলতায় এ-প্রথার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের সচেতনত পরিবারগুলো এ- প্রথার গোঁড়ামির প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে পারিবারিক কাজ সম্পাদন করছেন। পেশাগত বর্ণভেদের মূল লক্ষ্য ছিল পেশার উৎকর্ষসাধন ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক মঙ্গলসাধন করা। কিন্তু এই বর্ণপ্রথা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সবাই এর বিরোধী। তাই এ-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়।
BY : SVS FB GROUP