পাণিনি ছিলেন একজন ভারতীয় লৌহযুগের সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ ।তিনি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গান্ধার রাজ্যের পুষ্কলাবতী নগরীতে বিদ্যমান ছিলেন ।যতদূর জানা গেছে পাণিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি অঞ্চলের আটকের নিকট শালাতুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিনি দাক্ষীর পুত্র । পাণিনির যুগ বা কাল নিয়ে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় নি ।
ড. আহমদ শরীফের মতে তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকে বর্তমান ছিলেন । পাশ্চাত্যের গো সু স্টুকারের মতে তাঁর কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী । জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার এবং অয়েবার মনে করেন পাণিনির সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী । কথাসরিৎসাগর অনুসারে পাণিনি বর্ষ নামক আচার্যের নিকট থেকে ব্যাকরণ শিক্ষা গ্রহণ করেন । ইন্দ্রদত্ত এবং ব্যাড়ী ছিলেন তাঁর সামসময়িক সহপাঠী ।
অষ্টাধ্যায়ী
তিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী নামক সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত । এই গ্রন্থে তিনি সংস্কৃত রূপমূলতত্ত্বের ৩,৯৫৯টি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করেন । এই গ্রন্থটি বৈদিক ধর্মের প্রামাণ্য সহায়ক গ্রন্থ বেদাঙ্গের ব্যাকরণ শাখার মূল গ্রন্থ । এই গ্রন্থের অধ্যায় সংখ্যা ৮ এবং সূত্রসংখ্যা ৩৮৬৩টি । গ্রন্থটি অাট অধ্যায়ে বিভক্ত ব'লে এর নাম অষ্টাধ্যায়ী । প্রতি অধ্যায়ে চারটি পাদ বা পর্ব আছে ।এইগ্রন্থে সন্ধি , সুবন্ত , কৃদন্ত , উণাদি , আখ্যাত , নিপাত , উপসংখ্যান , স্বরবিধি , শিক্ষা , তদ্ধিত প্রভৃতি ব্যাকরণিক বিষয় স্থান পেয়েছে ।
অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম ব্যাকরণগুলির অন্যতম ।
যদিও পাণিনি উনাদিসূত্র, ধাতুপাঠ, গণপাঠ প্রভৃতি তাঁর পূর্বসূরিদের কয়েকটি ব্যাকরণগ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন । পাণিনির ব্যাকরণ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীল ভাষাবিজ্ঞানের প্রাচীনতম গ্রন্থ ।
নিরুক্ত , নিঘণ্টু ও প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলির সঙ্গে পাণিনির ব্যাকরণ ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাসের সূচনা ঘটায় । পাণিনির জ্ঞানগর্ভ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাকরণ তত্ত্ব বৈদিক সংস্কৃতের অন্তকাল ও ধ্রুপদি সংস্কৃতের সূচনাকালের সন্ধিক্ষণ রূপে পরিগণিত হয় ।
সংস্কৃত সাহিত্যে পণি নামে একটি গোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনি ফিনিসীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা একসময় ভারত মহাসাগরের উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিল। এদেরকে পণি, ফিনিকিয়, পিউনিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। পাণিনির পিতা ছিলেন ফিনিকিয় বা পণি গোষ্ঠীর মানুষ। তাঁর পিতার নাম ছিল শলঙ্ক।
এই কারণে অনেক সময় তাঁকে শলাঙ্কি বলা হয়। পাণিনির মা ইলেন দক্ষ জাতির কন্যা। অনেকের মতে পাণিনির মায়ের নাম ছিল দাক্ষী। এই সূত্রে অনেকে ক্ষেত্রে তাঁকে দাক্ষীপুত্র বা দাক্ষেয় নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পাণিনি পারিবারিক সূত্রে বেদোত্তর সনাতন পৌরাণিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত তিনি ছিলেন অহিগলমালার (শিব) উপাসক। সেইজন্য তাঁকে আহিক বলা হয়েছে।
তাঁর শিক্ষকের নাম ছিল উপবৎস। তাঁর রচিত ব্যাকরণের নাম– অষ্টাধ্যায়ী। কথিত আছে, মহাদেবের ঢাকের শব্দে চৌদ্দটি ধ্বনি উৎপন্ন হয়। এই ধ্বনি অনুসারে তিনি শব্দসূত্র তৈরি করেন। একে বলা হয়েছে শিবসূত্রজাল অথবা মাহেশ্বর সূত্র। মূলত এই সূত্রগুলি পাণিনির ব্যাকরণের চাবিকাঠি। শিবসূত্রের প্রত্যেকটির নাম সংজ্ঞা বা সংজ্ঞাসূত্র। এই ১৪টি শিবসূত্র হলো—
১. অ ই উ ণ্ ২. ঋ ৯ ক্ ৩. এ ও ঙ্ ৪. ঐ ঔ চ্ ৫. হ য ৱ র ট্ ৬. ল ণ্ ৭. ঞ্ ম ঙ্ ণ ন ম্ | ৮. ঝ ভ ঞ ৯. ঘ ঢ ধ ষ্ ১০. জ ব গ ড দ শ্ ১১. খ র্ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্ ১২. ক প য্ ১৩. শ ষ স র্ ১৪. হ ল্ । |
মনে রাখার সুবিধার জন্য পাণিনি এই সূত্রগুলোকে আরও সংক্ষিপ্ত করে নাম দিয়েছিলেন প্রত্যাহার (সংক্ষেপিত) সূত্র। এক্ষেত্রে প্রতিটি সূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ যুক্ত করে সংক্ষিপ্ত বা প্রত্যাহার সূত্র হয়েছিল।
প্রত্যহার সূত্র তৈরির বিধি
১. শিবসূত্রের বিচারে প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে।
২. প্রতিটি প্রত্যাহারের নামকরণ করা হয়েছে শিবসূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ দ্বারা। যেমন— প্রথম শিবসূত্রটি হলো — অ ই উ ণ্ । এক্ষেত্রে প্রত্যাহরটির নাম হবে অণ্।
৩. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শেষ ব্যঞ্জনবর্ণটি ইৎ হবে, অর্থাৎ অগ্রাহ্য হবে। যেমন প্রথম চারটি শিবসূত্র হলো—
প্রত্যহার সূত্র তৈরির বিধি
১. শিবসূত্রের বিচারে প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়েছে।
২. প্রতিটি প্রত্যাহারের নামকরণ করা হয়েছে শিবসূত্রের প্রথম ও শেষ বর্ণ দ্বারা। যেমন— প্রথম শিবসূত্রটি হলো — অ ই উ ণ্ । এক্ষেত্রে প্রত্যাহরটির নাম হবে অণ্।
৩. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে শেষ ব্যঞ্জনবর্ণটি ইৎ হবে, অর্থাৎ অগ্রাহ্য হবে। যেমন প্রথম চারটি শিবসূত্র হলো—
১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
এই চারটি শিবসূত্রের মিলিত সূত্র প্রত্যাহর হবে অচ্ । এর শেষ বর্ণ চ্ বাদ দিলে পাওয়া যাবে— অ ই উ ণ্ ঋ ৯ এ ও ঐ ঔ। এই বর্ণগুলোই হবে সংস্কৃত ভাষার স্বরধ্বনি। অর্থাৎ অচ্ প্রত্যাহর সূত্র দ্বারা স্বরধ্বনির সংখ্যা পাওয়া গেল। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে এই সূত্রে দীর্ঘ, হ্রস্ব, প্লুত স্বরধ্বনির উল্লেখ নাই।
একই ভাবে ৫ম শিবসূত্র থেকে ১৪শ শিবসূত্র থেকে পাওয়া যায় প্রত্যাহার সূত্র হল্। এর অর্থ হলো সমস্ত ব্যঞ্জনবর্ণ। পাণিনি ব্যাকরণে প্রত্যাহার সূত্র মোট ৪৩টি। তাঁর সমগ্র রচনাটি আটটি অধ্যায়ে বিভাজিত এই সূত্রে এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে- অষ্টাধ্যয়ী। এই ব্যাকরণের অন্যতম ভাষ্যকার ছিলেন পতঞ্জলি।
তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পঞ্চতন্ত্র মতে, তিনি সিংহের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
Credit: Wikipedia & Choturranga