এই মথ জংলার অজ্ঞাতবাসে আমার গুপ্তশ্বাস —
ঘুর্নিজলে গুলে খাচ্ছে লঘুপদ
ঘুর্নিজলে গুলে খাচ্ছে লঘুপদ
এখন অগূড় চন্দনে মিশ্রিত শ্লোকের শুদ্ধস্বরে সংবর্ত হয়ে উঠেছে প্রশ্বাস —
বর্ধিত হচ্ছে প্রত্নদেশের চন্দ্রবর্ষে ।।
বর্ধিত হচ্ছে প্রত্নদেশের চন্দ্রবর্ষে ।।
পৌরাণিক যুগে বিন্ধ্যপর্বত সমস্ত পর্বতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মাননীয় ছিল।
মহর্ষি অগস্ত্যর শিষ্য বিন্ধ্যপর্বত নারদের অভিশাপে ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকলে দেবতারা প্রমাদ গোনেন। তাঁরা অগস্ত্যকে অনুরোধ করেন যথাবিহিত উপায়ের কিছু ব্যবস্থা করার। অগস্ত্য মুনি স্ত্রী লোপামুদ্রাকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যের পথে অগ্রসর হন। বিন্ধ্য গুরু ও গুরুপত্নীকে মাথা নত করে অভিবাদন করেন। অগস্ত্য মুণি সেই অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং ‘তথাস্তু’ বলে আরও বলেন যে তিনি না ফেরা পর্যন্ত বিন্ধ্য পর্বত যেন সে ভাবেই অপেক্ষায় থাকেন। অগস্ত্য মুণি সে যাত্রায় আর ওই পথ দিয়ে ফেরেন না। সেই জন্য ‘অগস্ত্য যাত্রা’ বলে একটি শব্দবন্ধ চালু আছে। কবি শঙ্খ ঘোষের এই নিয়ে একটা অসামান্য কবিতা আছে।
সেই পর্বতে আছে এক যুগান্তরের দূর্গ। সেই বিন্ধ্য পর্বতে শৈল্যসুতা বিন্ধ্য বাসিনীর বাস।
ঋগ্বেদ থেকে মহাভারত ও অন্যান্য বিভিন্ন পুরানে দূর্গটির কথা সগৌরবে উল্লেখিত হয়েছে। ঋগ্বেদে এই দূর্গকে চেদি দেশের অঙ্গ বলে উল্লেখ করা করা হয়েছে।
যথা চিচ্চৈদ্যঃ কশুঃ শতমুষ্ট্রানাং দদত্সহস্রা দশ গোনাম্ ॥৩৭।।
যো মে হিরণ্যসংদৃশো দশ রাজ্ঞো অমংহত। অধস্পদা ইচ্চৈদ্যস্য কৃষ্টযশ্চর্মম্না অভিতো জনাঃ ॥৩৮॥
মাকিরেনা পথা গাদ্যেনেমে যন্তি চেদযঃ। অন্যো নেত্সূরিরোহতে ভূরিদাবত্তরো জনঃ ॥৩৯॥
উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত বান্দা জেলা , সেখানে আছে বিন্ধ্য পর্বত , তার হৃদয়ে অবস্থিত একটি সুপ্রাচীন দূর্গ। সেই সুপ্রাচীন দূর্গ খাজুরাহ মন্দিররাজির থেকে ৭.৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা এই দূর্গে ভারতের সামরিক তথা শৈল্পিক ইতিহাসে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুবিশাল এই দূর্গ কে ভারতের অপরাজেয় দূর্গ গুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। প্রাচীন মন্দির , মূর্তি ও শিল্পকলা সম্পদে পরিপূর্ণ এই দূর্গ।
হ্যাঁ আমি সেই সুপ্রাচীন কালিঞ্জর দূর্গে র কথা বলছি।
সুপ্রাচীন এই দূর্গের মধ্যস্থিত মন্দিরগুলির বেশিরভাগই তৃতীয় বা পঞ্চম শতাব্দী প্রাচীন , প্রায় গুপ্ত কালের সমসাময়িক।
বিষ্ণু পুরানে এই দূর্গকে বিন্ধ্য পর্বতের অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহেন্দ্রো মলয় সহ্যঃ শুক্তিমানৃক্ষপর্বতঃ॥
বিন্ধ্যশ্চ পারিযাত্রশ্চ সপ্তাত্র কুলপর্বতাঃ ॥
বিন্ধ্যশ্চ পারিযাত্রশ্চ সপ্তাত্র কুলপর্বতাঃ ॥
ইতিহাসের উত্তরণ ও অবনমের প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী কালিঞ্জর দূর্গ ও জনপদ যুগ থেকে যুগান্তরে বিদ্যমান। কেবল যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে নাম পরিবর্তন ঘটেছে। সত্যযুগে এই দূর্গ কীর্তিনগর , ত্রেতা যুগে মধ্যগড় , দ্বাপর যুগে সিংহলগড় নামে সুপরিচিত ছিল। যা কলিযুগে কালিঞ্জর নামে খ্যাতি লাভ করেছিল।
ইতিহাস অনুসারে প্রাচীন কালে এই অপরাজেয় দূর্গ জয়শক্তি চান্দেলের জেজাকভুক্তি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।
সাবেক রাজপুতানার অন্তর্গত ছিল বর্তমানের বুন্দেলখণ্ড ভূখণ্ডও। বুন্দেলখণ্ডের রাজপুতদের মধ্যে শৌর্য, বীরত্ব আর পরাক্রমে সবচেয়ে মহান ছিল চান্দেলা রাজপুতরা।
দশম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত জেজাকাভুক্তি বংশের চান্দেলা রাজপুতরা মূলত কান্যকুব্জ্যের গুর্জর-প্রতিহার রাজবংশের সামন্ত রাজ ছিলেন। দশম শতকের মধ্যভাগে চান্দেল রাজ যশোবর্মণ সর্বপ্রথম নিজেকে একজন স্বাধীন নৃপতি হিসাবে ঘোষিত করে বুন্দেলখণ্ডের ঐতিহাসিক চান্দেল রাজবংশের সূচনা করেন। মাহোবার প্রাচীন শিলালিপি অনুযায়ী চান্দেল বংশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন সম্রাট বিদ্যাধর চান্দেল। তিন প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ, বর্ণ রত্নাকর, কুমারপাল চরিত্র এবং পৃথ্বীরাজ রাসোতে চান্দেলদের প্রথমসারির ৩৬টি রাজপুত বংশের অন্যতম বলে উল্লেখিত করা হয়েছে।
বর্তমানে মূলত উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত সমগ্র বুন্দেলখণ্ড জুড়ে ছিল ক্ষত্রীয় জাত চান্দেল রাজপুতদের রাজ্যের সীমানা। তাঁদের সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধ তিনটে ঐতিহাসিক স্থান হল খাজুরাহো, মাহোবা এবং কালিঞ্জার দুর্গ।
পরে দশম শতকে এটি যথাক্রমে চান্দেল রাজপুত এবং শোলাঙ্কি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এই রাজাদের শাসনকালে গজনীর মাহমুদ , কুতুবউদ্দিন আইবক , শের শাহ সুরি ও হুমায়ুন এই দূর্গ আক্রমন ও দখলের বহু চেষ্টা করেছিল কিন্তু প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। জয়ী হয়েছিল সুপ্রাচীন দূর্গটি। এই দূর্গ আক্রমনের সময়ই কামানের গোলার আঘাতে শের শাহের মৃত্যু হয়। আকবর এই দূর্গ নিজের অধীনে আনলেও পরে এটি পুনরায় ছত্রশাল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়।
পরে এটি ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ভারতের স্বাধীনতার পর, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে এই দূর্গটি ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে।
চলুন ঘুরে আসি ইতিহাসে র সেই দূর্গে…
বিন্ধ্য পর্বত আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। একটা দীর্ঘ সময় তাকে অতিক্রম করে তার পরপারে বসবাসকারীদের উপর আক্রমনের কথা অনেকেই স্বপ্নেও চিন্তা করতেন না। সেখানে বাস করেন বিন্ধবাসিনী দেবী। আর তার দক্ষিণ পূর্ব অংশে অবস্থিত যুগান্তরের কালিঞ্জর দূর্গ।
এটি সমুদ্রতল থেকে ১২০৩ ফুট (৩৬৭ মিটার) উচ্চতায় ২১৩৩৬ বর্গ মিটার এলাকা গঠিত। পর্বতের এই অংশটি ১১৫০ মিটার প্রশস্ত এবং ৬ থেকে ৮ কিমি । এর পূর্ব দিকে অবস্থিত কালিন্জর পাহাড়টি আকারে ছোট হলেও উচ্চতা সমান।
এই স্থানের আবহাওয়া বন্ধুর প্রকৃতির। গ্রীষ্মের আবহাওয়া অতীব তপ্ত ও কষ্ট দায়ক থাকে। মাঝে মাঝে লু অর্থাৎ উত্তপ্ত বাতাস বয়। শীতকালের প্রচন্ড শীতলতা ও বর্ষায় হয় প্রবল বর্ষণ।
এখানের প্রধান নদী হল বাগে বা বাগাই । সারা বছর রুক্ষ শুষ্ক বাগে বর্ষায় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। পর্বত থেকে অন্তত এক মাইল দূরে প্রবাহিত এই নদীটি পান্না জেলার কোহারীর নিকটস্থ বৃহস্পতি কুন্ড পর্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করে দক্ষিণ-পশ্চিম বাহী হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে হতে যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়াও ছোট নদী বানগঙ্গাও যমুনা গামিনী হয়েছে।
সত্যযুগে কালিঞ্জর অর্থাৎ কীর্তিনগর চেদি নরপতি উপরিচরি বসুর সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তাঁর রাজধানী ছিল শুক্তিমতি নগরী। ত্রেতা যুগে বাল্মীকি রামায়নুযায়ী শ্রী রাম এই কালিঞ্জর দূর্গ অর্থাৎ মধ্যগড় কোনো একটি বিশেষ কারনে ভরবংশীয় ব্রাহ্মন কে দান করেছিলেন। দ্বাপর যুগে পুনশ্চঃ চেদি বংশ কালিঞ্জর দুর্গটি অর্থাৎ সিংহলগড় নিজ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। এর রাজাই ছিলেন শিশুপাল। এর পর দূর্গ মধ্যভারতের বিরাট রাজার অধীনে আসে।
কালিঞ্জর দূর্গের কথা সর্বপ্রথম উল্লিখিত নাম আসে শকুন্তলা দুষ্মন্তর সন্তান সসাগড়া পৃথিবীর রাজা ভরতের। কর্নেল টডের বক্তব্য অনুসারে ভরত রাজা যে চারটি কেল্লা বানিয়েছিলেন বা সংস্কার করেছিলেন তার মধ্যে কালিঞ্জর ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
কালিঞ্জর অর্থাৎ যে কাল অর্থ সময়ের উপরে যে জয় অর্থ বিজয় প্রাপ্ত হয়েছে…
সেই যে যখন ত্রিলোক অমৃত কুম্ভের সন্ধানে অমরত্বের আশায় ছুটছিল, সেই যে যখন দুর্বাসার অভিশাপে সবাই হল শ্রী হীন, সেই যে যখন শ্রী চলে গেলেন সমুদ্রের তলায় , সেই যখন কত কোলকাহল হল দেব ,দানব ,দৈত্য র মধ্যে। তারা সবাই যেমন অমরত্ব চায় তেমনই শ্রীহীনতা কে ঘোচাতে চায়।
অমরত্ব, অমরত্বের জন্য তো দৈত্য গুরু শুকলাচার্য দেবাদিদেব মহাদেবের নিকট পেয়েছেন মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র। কিন্তু দেব কুল…তাদেরও কিছু লাগে বৈকি…
সুতরাং, তাদের সন্ধান হল অমৃত কুম্ভের। দৈত্য দানব কুলের রাজা বলি তখন স্বর্গের অধিকারী। একা দেবতাদের তাই সমুদ্র মন্থনের অধিকার নেই। দৈত্য দানব কুলও সেই কর্মের ভাগী হলেন। ব্রহ্মভা র আদেশে ত্রিলোকের যত ঔষদি বৃক্ষ এনে ফেলা হল সমুদ্রে। মন্দর পর্বত হল দন্ড। বিষ্ণু কূর্ম অবতারে সেই পর্বত ধারণ করলেন। বাসুকি নাগ হলেন রজ্জু। মনথিত হল সমুদ্র। বহু মহামূল্য বান বস্তু র সঙ্গে উঠেন শ্রী লক্ষী ।
আর কি উঠল? উঠল হলাহল…সব ভালোরই খারাপ থাকে…কিন্তু খারাপ , বিষকে কে নেবেন? নেবেন নেবেন…যিনি স্বয়ম্ভু সৃষ্টি স্থিতি লয় যার করে তিনিই নেবেন.. তিনি তো নিজেই অমৃত। তাঁর অমৃত , অমরত্ব লাগে না। বিষকেও তাই তিনি ধারণ করতে সক্ষম। দেবাদিদেব গ্রহণ করলেন সেই গরল। মহাদেব হলেন নীলকন্ঠ , বিশ্ব চরাচর রক্ষিত হল। আর কি হল? দেবী পার্বতী তারা রূপ ধারণ করে মহাদেবের কন্ঠের বিষ রোধ করে হলাহলের জ্বালা তাড়ন করলেন । এরপর দেবাদিদেব বিন্ধ্যাচলে এসে ধ্যান মগ্ন হলেন। কাল অর্থাৎ সময়ের উপর বিজয় প্রাপ্ত করলেন । সৃষ্টি হল কালিন্জর…তাই কালিন্জরের অধিকারী কেবলমাত্র নীলকন্ঠ। এখানের অবস্থিত মন্দিরটি নীলকন্ঠ শিবের মন্দির হিসাবে সুপরিচিত।
পদ্মপুরানে এই স্থানকে নবঊখল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম স্থান গুলির মধ্যে অন্যতম। মৎস পুরাণে এই স্থানকে অবন্তিকা ও অমরকন্টকের সঙ্গে অবিমুক্ত ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা উপদেশ মূলক কাহিনী, গ্রন্থ ও জাতক মালায় এই দুর্গকে কালগিরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে । ব্রহ্মপুরাণে কালিঞ্জর একটি পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র।
গরুড় পুরাণে কালিন্জর কে মহা তীর্থ বলা হয়েছে ,তথা সর্ব পাপহারি মোক্ষ ক্ষেত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গৌবর্ণং পরমং তীর্থ, তীর্থ মাহিষ্মতী পুরী॥
কালংজর মহাতীর্থ, শুক্রতীর্থ মনুত্তমম্॥
কালংজর মহাতীর্থ, শুক্রতীর্থ মনুত্তমম্॥
কৃতে শোচে মুক্তিদশ্চ শাংর্গ্ংগধারীতন্দিকে॥
বিরজং সর্বদং তীর্থ স্বর্ণাক্ষংতীর্থমুতমম্॥
বিরজং সর্বদং তীর্থ স্বর্ণাক্ষংতীর্থমুতমম্॥
উপত্যকার খোলা সমভূমিতে, ঘন বন ও তৃণভূমি ও নাম না জানা ফুল দ্বারা বেষ্টিত। এই স্থানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মহিমা এই স্থানটি আধ্যাত্মিকতা কে প্রস্ফুটিত করে।
আসলে এই দূর্গ ঠিক কবে নির্মিত হয়েছিল তার স্রোত বা সূত্র আজও অজ্ঞাত। অনেকেই মনে করেন বা জনশ্রুতি অনুসারে এই দূর্গের স্থাপনা চান্দেল বংশের রাজা চন্দ্র বর্মা করেছিলেন। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে , এই দুর্গের নির্মাণ কেদার বর্মা দ্বারা দ্বিতীয় ও চতুর্থ শতকে হয়েছিল।
১৬ শতাব্দীর ফার্সী ঐতিহাসিক ফরিস্তার বক্তব্য অনুসারে কালিঞ্জর নামক শহরের স্থাপনা কেদার নামক এক রাজা তৃতীয় শতকেই করেছিলেন কিন্তু চান্দেল শাসন কালে দূর্গ প্রচারে আসে। চান্দেল বংশের ইতিহাস পড়লে আবার দেখা যায় এটি চান্দেল রাজা নির্মাণ করেছিলেন । তবে যেই করুন তিনি অসামান্য ছিলেন…
চান্দেল শাসন কালে রাজাদের উক্তি বিশেষ উপাধি প্রচলিত ছিল…কালিঞ্জরাধিপতি…উপাধি থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে কালিঞ্জর চান্দেলদের নিকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও মহত্বপূর্ণ ছিল।
কালিঞ্জর প্রাচীন ইতিহাস লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব এই দূর্গের ইতিহাস পৃষ্টভূমি নানা যুদ্ধ কেন্দ্রিক আক্রমণে পরিপূর্ণ। বিভিন্ন রাজা মহারাজা ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় শক্তি এই দূর্গকে অধিকার করার জন্য বড় বড় আক্রমন করেছিল। সেই জন্যই হয়ত দূর্গের অধিকারর এক সাম্রাজ্য থেকে অন্য সাম্রাজ্যের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু খুব অদ্ভুত ঘটনা হল যে , একমাত্র চান্দেলরা ব্যতীত অন্য কেউ এই দূর্গে কে কেন্দ্র করে বেশিদিন শাসন কার্য চালাতে পারেনি।
প্রাচীন ভারতে কালিঞ্জরের উল্লেখ বেদ , পুরান , রামায়ন মহাভারত সহ বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যতে উল্লিখিত হয়েছে সে তথ্যঃ পূর্বেই পরিবেশিত হয়েছে। শাক্য সিংহ বুদ্ধদেবের যাত্রা পথে এই দূর্গের উল্লেখ আছে। গৌতম বুদ্ধের সময় এখানে চেদি বংশ রাজত্ব করতেন। এর পরে এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এই সময়ই এটি বিন্ধ্য আটবি নামে বিখ্যাত হয়েছিল। ইতিহাস বলে এখানে সেই রামায়ন মহাভারতের যুগে হৈহয় বংশের রাজা কৃষ্ণরাজ থেকে শুরু করে নাগ , পান্ডব ,শুনগ ও গুপ্ত বংশীয় শাসনাধীন ছিল।
সমুদ্রগুপ্তের প্রয়াগ প্রশস্তিতেও এই অঞ্চলকে বিন্ধ্য আটবি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর এটি বর্ধন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। গুর্জ্জর প্রতিহার বংশের নাগভট্টের রাজত্ব কাল অবধি তাঁরা এই দুর্গের উপরে অধিকার ভোগ করেন। এরপর আসে চান্দেল বংশ। ইতিহাস অনুসারে চান্দেলগন গুর্জ্জর দেরই মান্ডলিক রাজা ছিলেন। ওই সময়ের প্রতিটি গ্রন্থ বা অভিলেখাতে এই দূর্গের নাম উল্লিখিত ছিল।
১০২৩ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জরে আক্রমণ করল গজনীর মাহমুদ। স্বাভাবিক ভাবেই অন্য মন্দির ও হিন্দু সম্পত্তি লুন্ঠনের মতই সমান ভাবেই কালিঞ্জর দূর্গ লুণ্ঠিত হল। কিন্তু সুবিশাল দূর্গটিতে অধিকার স্থাপন করতে পারল।
মানুন বা না মানুন , এটি সত্য যে ভারতীয় সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির নিমিত্ত কিছু চাটুকার ঐতিহাসিক বারংবার তাকে বিকৃত করেছে। তো সত্য ইতিহাস বলে যে , বাবরের মুঘল সেনাপতি হাসান খাঁ ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মেবাতপতি থেকে প্রত্যাবর্তন কালে এই সুপ্রাচীন দূর্গ দখলের প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু কিছুটা অধিকার করলেও তাকে ধরে রাখতে অক্ষম হয়।
শের শাহ সুরি কালিঞ্জর দূর্গ অধিকারের নিমিত্ত ২২ মে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে চান্দেল সাম্রাজ্য আক্রমন করে।এই আক্রমন ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। উক্কা নামক এক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র (তোপ ) দাগে দূর্গের দেওয়ালে। কিন্তু বিধিই সাহস হাঁসি হেঁসেছিলেন। তোপ দূর্গের দেওয়াল থেকে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছিল শের শাহের নিকট। সেই প্রতিহত হত হওয়া তোপের আঘাতেই মৃত্যু হয় শেরশাহের।
আকবর নামার বিবরনানুযায়ী ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর দূর্গটি নাকি বীরবলকে উপহার দিয়েছিল এবং বীরবলের পর এই দূর্গ পুনরায় ছত্রশাল সম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। এর পর পান্নার শাসক হরদেব এই দূর্গের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮১২ খ্রিস্টাব্দ ইংরেজির মে মাসে কালিঞ্জর দূর্গ ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীর আক্রমন এই দূর্গের বেশ কিছু অংশ খুব বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে চিন্হ আজও এই সুপ্রাচীন দূর্গটি তার দেওয়াল ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে বহন করে চলেছে।১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও এই দূর্গের কিছু অংশ ব্রিটিশ অধিকারে ছিল। ভারতের স্বাধীনতার অর্জনের সাথে এই দূর্গটি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে।
এই কালিঞ্জর দূর্গ এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদ ও নাগরিক জীবন উভয়ই ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বহু প্রাচীন মন্দির, মূর্তি , শীলালেখ এবং গুহার অবস্থিতি ইতিহাসের প্রবাহমান কালকে বহন করে নিয়েছিলেছে। এই দূর্গে কোটি তীর্থের নিকট প্রায় ২০ হাজার বছর পুরাতন শঙ্খ লিপি স্তিত আছে। যে লিপিতে রামায়নের যুগে শ্রী রামের কালিঞ্জর দূর্গে বনবাস কালে আগমনের কথা উল্লিখিত আছে। এই লিপি অনুসারে শ্রী রামচন্দ্র সীতা কুন্ডের নিকট সীতা সেজ যেখানে সেখানে অধিষ্ঠান করেছিলেন।
কালিঞ্জর সৌধ সংস্থানের তৎকালীন নির্দেশক শ্রী অরবিন্দ ছিরৌলিয়ার মন্তব্যনুসারে এই দূর্গের উল্লেখ যেমন বিভিন্ন প্রাচীন পৌরাণিক গ্রন্থে উল্লেখ আছে তেমনি বুড্ডা বুড্ডি সরোবরের নিকটস্থ নীলকন্ঠ মন্দিরের অভ্যন্তরে বহু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সঞ্চিত আছে যাতে চান্দেল সাম্রাজ্যের সময়কালের বিভিন্ন বিবরণ রক্ষিত আছে।
সুপ্রাচীন কালিঞ্জর দূর্গ কিন্তু ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় আগ্রাসন থেকে মুক্তি পায় নি। এই দূর্গের প্রথম দুয়ারে ভালো করলে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, সেখানে ১৬ শতকের সময়কালের ঔরঙ্গজেবের একটি প্রশস্তি আছে। যেটি ঔরঙ্গজেবের নির্দেশ অনুসারে বানানো হয়েছিল। এছাড়াও দুর্গের কাছেই কাফের ঘাঁটি বলে একটি স্থান আছে। ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে এই স্থানেই শেরশাহ সুরির ভাতুস্পুত্র ইসলাম শাহ এখানে একটি প্রশস্তি লাগিয়েছিল। শুধু তাই নয় , ইসলাম শাহ এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিল। কালিঞ্জর দূর্গের নাম পরিবর্তন করে তাকে শেরকোহ রাখাবার চেষ্টাও করে ছিল।
ডক্টর বিডি গুপ্ত ও অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্যঃ থেকে জানতে পারা যায় অসীম শক্তিময়ী রানী দূর্গাবতীর পিতা যস্বসী রাজা কীর্তিবমর্ন যখন
কালিঞ্জর দূর্গে রাজত্ব করতেন । শেরশাহ কালিঞ্জর আক্রমন করলে মহারাজ সহ তাঁর ৭২ জন সঙ্গীকে হত্যা করেছিল শেরশাহ সুরির ভাতুস্পুত্র ইসলাম শাহ ।
কালিঞ্জর দূর্গে রাজত্ব করতেন । শেরশাহ কালিঞ্জর আক্রমন করলে মহারাজ সহ তাঁর ৭২ জন সঙ্গীকে হত্যা করেছিল শেরশাহ সুরির ভাতুস্পুত্র ইসলাম শাহ ।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ কালিঞ্জর দূর্গ থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন শিল্প কর্ম , মূর্তির ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি একত্রিত করে সংগ্রহশালায় সংরক্ষন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এতে গুপ্ত যুগে থেকে মধ্যযুগীয় ভারতের অনেক অভিলেখ সম্পদ হিসাবে সঞ্চিত আছে। এখানে সাংখ্য লিপির তিনটি অভিলেখ পাওয়া যায়।