শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রে জগতের রাধা কে?



শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের বিকৃতি ও এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে •••


সমগ্র হিন্দুর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনপ্রবাহের আলোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও চরিত্রই যেন সমস্ত কিছুকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় সর্বতোমুখী মহাপ্রতিভাশালী জীবন ও চরিত্র কল্পনা করতেও পারেননি। জগতের ইতিহাসে আর একটি নিখুঁত মহাজীবন পাওয়া যায়, সে হচ্ছে  শ্রীরামচন্দ্র; সেই নিখুঁত জীবনেও কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মতো এতো সর্বতোমুখী শক্তি ও প্রতিভা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি।

হিন্দুজাতির মহাদুর্ভাগ্য; তাই আজ সেই ধর্ম–মাম্রাজ্য–সংগঠক বিরাট মহামানব শ্রীকৃষ্ণের শতাধিক বর্ষব্যাপী উত্তাল জীবন–প্রবাহের কর্মপ্রতিভা ও কীর্তিকলাপের স্মৃতিগুলি বিসর্জন দিয়ে তাঁকে বৃন্দাবনের ভাবসাধানার প্রতিমা সাজিয়ে ননীচোরা, বসনচোরা, গোপীচোরা, বানিয়ে নিয়েছি। অবশ্য এই ভাবসাধানার বলে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, মীরাবাঈ প্রমুখের ন্যায় কত মহাসাধক–সাধিকা আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই উচ্চ দর্শন কয় জন বোঝে?

অনধিকারীরা ব্যাপক ভাবে এ চর্চা করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। তাই জাতব হিসাবে হিন্দুগণ ক্লীব, কাপুরুষ, ভীরু, ইন্দ্রিয়পরায়ণ, ব্যভিচারী, ধর্মধক্ষজী, আত্মাপ্রতারক হয়ে হাজার বছরেরও অধিককালে দুনিয়ার যত দিগ্বিজয়ী শক্তিশালী জাতির লাথি–জুতা–গুঁতা খেতে খেতে মরণের দুয়ারে হাজির হয়েছি।
মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ নিষেধ করে গেলেন— হরিনাম সংকীর্ত্তনের অধিকারী আপামর সকলে; কিন্তু কৃষ্ণলীলা আস্বাদনের অধিকারী কদাচিৎ এক–আধজন; সুতরাং অনধিকারীরা লীলা–আস্বাদনের দিকে যেও না। সেই গৌরাঙ্গের দোহাই দিয়েই আজকাল শিক্ষিত অশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত সাধারণ হিন্দু—সকলেই লীলা রসকীর্ত্তনে মাতোয়ারা! অথচ এক বিন্দু বীর্য্যধারণের শক্তিও নেই। মহাপ্রভু সাবধান করে দিলেন (সন্ন্যাসী বৈষ্ণবদের জন্য)—কাঠের নারীমূর্তির প্রতিও দৃষ্টিপাত করিও না; মনে কামভাবের উদয় হবে। স্ত্রীলোকের সহিত আলাপ করার দরুন প্রিয় শিষ্য হরিদাসকে তিনি জন্মের মতো পরিত্যাগ করলেন।  অথচ ইন্দ্রিয়সেবী সাধারণ নরনারী শ্রীকৃষ্ণলীলার চিন্তা করতে গিয়ে গেপীদের চিন্তা, সখীদের চিন্তা, রাধিকা ও সখীদের সহিত কৃষ্ণের রঙ্গরস, মান–অভিমান, ইন্দ্রিয়–সম্ভোগ ব্যাপার চিন্তা, বর্ণনা, আলোচনা, ধ্যান ও গান করছে। ফলর ভগবান ও ধর্মের নামে ভণ্ডামি, লাম্পট্য ও ক্লীবতার গহক্ষরে আপাদমস্তক ডুবেছে; তাই আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণমুর্তি চূর্ণিত হতে দেখলেও প্রতিবাদ প্রতিকার দূরের কথা, বিপদের আশঙ্কায় প্রাণভয়ে পলায়ন করে। আজ সাধারণ নরনারী সংযম–সদাচারের মস্তকে পদাঘাত করে দৈনন্দিন জীবনে ছাগ–কুকুরের ন্যায় অবিরত ইন্দ্রিয়সম্ভোগে প্রমত্ত; তাতেও পরিতৃপ্তি নেই।
সমগ্র হিন্দুজাতির আরাধ্য আদর্শ, হিন্দুধর্ম ও জাতীয়তার পরিপূর্ণ বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও চরিত্রের এই বিকৃতি বিদূরিত করে আর্য হিন্দুজাতির সংস্কারক মহাসমন্বয়াচার্য্য ধর্ম–সাম্রাজ্য–সংগঠক শ্রীকৃষ্ণের জীবনের যথার্থ আদর্শ ও ঐতিহাসিক কীর্তিকলাপের প্রচার আবশ্যক; যার আলোকে জাতি সম্মিলিত, সঙ্ঘবদ্ধ, মহাপরাক্রমী, দিগ্বিজয়ী জাতিরূপে গড়ে উঠতে পারে।

শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের বিকৃতি
(শ্রীমৎ স্বামী বেদানন্দ)

শ্রীকৃষ্ণ ছোটবেলার কথাঃ-

শ্রীকৃষ্ণ শ্রীবৃন্দাবনে ১০ বছর ৮ মাস ছিলেন। এরপর অক্রুর তাকে নিয়ে আসেন বলরাম সহ মথুরায়। সেখানে কংসকে বধ করে তার পিতা উগ্রসেনকে রাজা করে মথুরার শাসনভার তার হাতে দিয়ে দুই ভাই সন্দীপনী মুনির পাঠশালায় ভর্তি হলেন লেখা-পড়া করার জন্য।

শ্রীকৃষ্ণ কাকে কত বছর  বয়সে  বধ করেছিলেন তাদের নামঃ—

✴ ১ মাস বয়সে শ্রীকৃষ্ণ পুতনাকে বধ করেছিলেন।
✴ ৩ মাস বয়সে শ্রীকৃষ্ণ শকটাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ১ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ তৃনাবর্তাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ২ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ বৎসাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ৪ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ বকাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ৫ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ অঘাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ৬ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ ধেনুকাসুর বধ করেছিলেন।
✴ ৭ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ গিরিগোবর্ধন ধারণ করেছিলেন।
✴ ৮ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ সলীলা প্রদর্শন করেছিলেন।
✴ ১২ বছর বয়সে শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণের জীবনী সম্পর্কে সম্পূর্ণ তত্ত্ব হরিবংস পুরাণে পাওয়া যায়।

"এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে?"
      (শ্রী গৌর নিতাই গোস্বামী)

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও কবি জয়দেবের কাব্যগ্রন্থ ছাড়া কোন প্রাচীন গ্রন্থেই রাধা নেই। মূল মহাভারতে রাধা নাই। চার বেদে রাধা নামক কোন রমনীর নামগন্ধ নাই। ১০৮ টি উপনিষদের সুবিশাল জ্ঞান বিজ্ঞানের দিগন্তে রাধা নামক কোন কৃষ্ণ প্রেয়সীর পদচারণ নাই। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিসৃত অমর গ্রন্থ গীতার ১৮ টি অধ্যায়ের শত শত শ্লোকের হাজার হাজার শব্দ রাশির মধ্যে কোথাও রাধারাণীর উল্লেখ নাই। এমনকি বৈষ্ণব ধর্মীয় মানুষজনের মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ মূল ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ের ভিতরেও শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরূপিনী কোন রাধা নামের উল্লেখ নাই। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিকরা দার্শনিক তত্ত্বরূপে (যা মাত্র ৫০০ বছরের প্রাচীন) শ্রীকৃষ্ণের লীলা শক্তির যে প্রধান তিন ভাগের (স্বরূপ শক্তি, জীবশক্তি, মায়া শক্তি) বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে স্বরূপ শক্তির আবার যে তিনটি উপভাগ (সৎ, চিৎ, আনন্দ) সেই উপভাগের মধ্যে আনন্দ তত্ত্বের মানবী রূপ হিসেবে কল্পনা করেছেন রাধাকে। রাধাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহিত্যরস সৃষ্টির খাতিরে। তাই আমরা রাধাকে ব্যাপকভাবে দেখতে পাই সাহিত্য জগতে। বৈষ্ণব কাব্যের ছত্রে ছত্রে রাধা আছেন। নানা ভাব মাধুর্যের লীলা রসে রাধা সদা বিচরণশীল। তাই রাধা বৈষ্ণব সাহিত্যের লীলা রসরঙ্গিনী মানসী চরিত্র। কিন্তু কোনভাবেই রাধা ঐতাহাসিক চরিত্র নয়। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণ নাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির বা প্রতিমা নাই। বৈষ্ণবীয় অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা অধিক প্রাধান্য লাভ করেছেন। যা ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশী...

জয় শ্রীরাম
হর হর মহাদেব

লেখকঃ— শ্রী বাবলু মালাকার
চট্টগ্রাম বিভাগীয় এক্টিভ কর্মী 
(সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, চট্টগ্রাম)

নবীনতর পূর্বতন