পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের পবিত্রতম চিহ্ন স্বস্তিকা।

স্বস্তিকা,পবিত্রতম চিহ্ন স্বস্তিকা।

স্বস্তিকা প্রতীক শুধুমাত্র সনাতন ধর্মের নয়। বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেরও প্রতীক। বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের পর দ্বিতীয় প্রতীক। জৈন ধর্মাবলম্বীদের একমাত্র প্রতীক হলো স্বস্তিকা। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওঙ্কারের ॐ পরে 卐 স্বস্তিকা দ্বিতীয় পবিত্র প্রতীক হিসাবে পূজিত। স্বস্তিকা মূলত সনাতন ধর্মের শুভমঙ্গল চিহ্ন। আমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীনকাল থেকে শুভমঙ্গল চিহ্ন, সেবাময় প্রতীক, শান্তির প্রতীক এবং কল্যাণময় ঈশ্বরের প্রতীক বলে বিবেচিত হয়ে আসা এই— 卐 স্বস্তিকা পবিত্র বেদে স্বস্তি নামে আছে।


স্বস্তি শান্তিপাঠ

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিং শৃণুয়াম দেবাঃ।
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্য জত্রাঃ
স্থিরৈঃ অঙ্গৈঃ তুষ্টু বাংসঃ তনুহভিঃ।
ব্যশেম দেবহিতং যৎ আয়ুঃ।
ওঁ স্বস্তি নো ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ।
স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্বদেবাঃ।
স্বস্তি নোস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ।
স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।
(ঋগ্বেদ ১/৮৯/৮, ৬) [১]

অর্থাৎ— হে দেবগণ, আমরা যেন কান দিয়ে কল্যানবচন শুনি; হে যজনীয় দেবগণ, আমরা চোখ দিয়ে যেন সুন্দর বস্তু দেখি; সুস্থদেহের অধিকারী হয়ে আজীবন আমরা যেন তোমাদের স্তবগান করে দেবকর্মে নিয়োজিত থাকি। বৃদ্ধশ্রবা ইন্দ্র আমাদের মঙ্গল করুন; সকল জ্ঞানের আধার ও জগতের পোষক পূষা আমাদের মঙ্গল করুন; অহিংসার পালক তার্ক্ষ্য (গরুড়) আমাদের মঙ্গল করুন। ওঁ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক - এই ত্রিবিধ বিঘ্নের বিনাশ হোক।


ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঈি্মস্তষ্টুবাঁ্ সস্তনূভির্ব্যশেম দেবাহিতং যদায়ুঃ।।
স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ।
স্বস্তি নস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।।
                      (সামবেদ, ২৫/২১)

অনুবাদঃ— হে দেবগণ! অামরা ভগবানের অারাধনা করতে করতে কর্ণগুলি দ্বারা কল্যাণময় বচন শুনি নেএগুলির দ্বারা কল্যাণ  ই দেখি সুদৃঢ় অঙ্গগুলির এবং শরীররগুলির দ্বারা ভগবানের স্তুতি করতে করতে অামরা যে অায়ু অারাধ্যদেব পরমাত্মার কর্মে অাসে তার উপভোগ করি চতুর্দিকে প্রসারিত সুযশস্বী ইন্দ্র অামাদের জন্য কল্যাণ পোষণ করুন বিশ্ব-ব্রক্ষাণ্ডের জ্ঞাতা পূষা অামাদের জন্য কল্যাণ পোষণ করুন অরিষ্টসমূহকে সমাপ্ত করার জন্য চক্রসদৃশ শক্তিশালী গরুড়দেব অামাদের জন্য কল্যাণ পোষণ করুন তথা দেবগুরু বৃহস্পতিও অামাদের জন্য কল্যাণ করুন পরমাত্মন্! অামাদের ত্রিবিধ তাপ যেন শান্ত হয়।

ঋগ্বেদের পুষ্ট "বায়ু" সোম ও বৃহস্পতি "স্বস্তি" ঐশ্বর্য্য পন্থা—          (ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১১-১৫)


ওঁ স্বস্তি নো মিমীতামশ্বিনা ভগঃ স্বস্তি দেব্য দিতিরন বর্ণঃ।
স্বস্তি পূষা অসুরো দধাতু নঃ স্বস্তি দ্যাবাপৃথিবী সুচেতুনা।।
                   (ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১১)

অনুবাদঃ— উপাস্য প্রভু দিন ও রাত্রিকে আমাদের জন্য কল্যাণকারী করুন। প্রভুর অখণ্ডনীয় দিব্য শক্তি অলসদের অন্তরে উৎসাহের সঞ্চার করুক। পুষ্টিশক্তি সম্পন্ন বৃষ্টি কল্যাণকারিণী হউক। দ্যুলোক ও ভূলোক চেতন জীব দ্বারা আমাদের কল্যাণ সাধন করুক।


ওঁ স্বস্তয়ে বায়ুমুপ ব্রবামহৈ সোমং স্বস্তি ভুবনস্য যস্পতিঃ।
বৃহস্পতিং সর্বগণং স্বস্তয়ে স্বস্তয় আদিত্যাসো ভবন্তু নঃ।।
(ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১২)

অনুবাদঃ— কল্যাণের জন্য আমরা বায়ুর কীর্ত্তি গান করি, ব্রক্ষ্মাণ্ডের পোষক চন্দ্রমার কীর্ত্তি গান করি, সকলে মিলিত হইয়া বৃহস্পতির কীর্ত্তি গান করি। অখণ্ড পরমাত্মা আমাদের কল্যাণ বিধান করুন।


ওঁ বিশ্ব দেবা নো অদ্যা স্বস্তয়ে বৈশ্বানরো বসুরগ্নিঃ স্বস্তয়ে।
দেবা অবন্ত্বৃ ভব স্বস্তয়ে স্বস্তিনো রুদ্রঃ পাত্বংহসঃ।।
                  (ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১৩)

অনুবাদঃ— দিব্যগুণ সমূহ আমার প্রতি আজ মঙ্গল দায়ক হউক, সব মনুষ্যের মধ্যে বিরাজমান এবং সকলের অধিষ্ঠাতা অগ্নি কল্যাণদায়ক হউক, প্রকাশমান বিদ্বানেরা রক্ষা করুন, পরমাত্মা আমাদিগকে পাপ হইতে শান্তির জন্য রক্ষা করুন।


ওঁ স্বস্তি মিত্রাবরুণা স্বস্তি পথ্যে রেবতি।
স্বস্তি ন ইন্দ্রশ্চাগ্নিশ্চ স্বস্তিনো অদিতে কৃধি।।
                   (ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১৪)

অনুবাদঃ— প্রাণ ও অপান কল্যাণময় হউক, ধনাগমের পথ কল্যাণময় হউক। ঐশ্বর্য্য ও অগ্নি কল্যাণময় হউক।হে পরমাত্মা আমাদের কল্যাণ সাধন কর।


ওঁ স্বস্তি পন্থামনুচরেম সূর্য্যাচন্দ্রমসাবিব।
পুর্নদদতাঘ্নতা জানতা সঙ্গমে মহি।।
                  (ঋগ্বেদ, ৫/৫১/১৫)

অনুবাদঃ— সূর্য্য ও চন্দ্রের ন্যায় আমার কল্যাণমার্গে চলিব এবং দানশীল অহিংসক বিদ্বান্ পুরুষের সঙ্গ লাভ করিব।

             
ওঙ্কার সর্বশ্রেষ্ঠ একমাত্র মহামন্ত্র

ওঁ প্রকৃতপক্ষে কি?

সনাতন ধর্মের মহামন্ত্র ওঁ যা আমাদের মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্ত করে মোক্ষলাভ করাবে। যা আমাদের আত্মার উপলদ্ধি করাবে। কারণ সনাতন ধর্মে মোক্ষলাভই সর্বোচ্চ পদ তাই ওঁ ছাড়া কোনো গতি নেই।

তাহলে চলুন দেখা যাক— বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা ও গীতায় ওঙ্কার কি


পবিত্র বেদ


বায়ুবনিলমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীরম।
ওম ক্রতো স্মার ক্লিবে স্মর কৃতং স্মর।
                 (যর্জুবেদ, ৪০/১৫) 

অনুবাদঃ— হে কর্মশীল জীব। শরীর ত্যাগের সময় পরমাত্মার নাম ওঙ্কার স্মরণ কর। আধ্যাত্বিক সামর্থ্যকেকে স্মরণ কর। প্রথমে আধ্যাত্বিক প্রাণ, অধিদৈবিক প্রাণ এবং পুনরায় প্রাণ স্বরুপ পরমাত্মাকে (ওঁ) প্রাপ্ত হও।
                           
উপনিষদ

যদর্চিমদ্ যদণুভ্যোহণু চ, যস্মিঁল্লোকা নিহিতা লোকিনশ্চ
তদেতদক্ষরং ব্রহ্ম স প্রাণস্তদু বাঙমনঃ।
তদেতৎ সত্যং তদমৃতং তদ্বেদ্ধব্যং সোম্য বিদ্ধি।।
                  (মুণ্ডক উপনিষদ, ২/২/২)

অনুবাদঃ— যিনি দীপ্তিমান্, যিনি সূক্ষ্ম বস্তুসমূহে হইতে সূক্ষ্ম এবং যিনি স্থূল হইতে স্থূল, যাঁহাতে লোকসমূহ এবং লোকবাসিগণ অবস্থিত, তিনিই সর্বাস্পদ অক্ষর ব্রহ্ম। তিনিই প্রাণ, তিনিই আবার বাক্ ও মন। সেই ব্রহ্মই সত্য, সেই ব্রহ্মই অমৃত। হে সোম্য তাহাকেই ভেদ কর।


ধনুর্গৃহীত্বৌপনিষদং মহামন্ত্রং শরং হু্যপাসানিশিতংসন্ধয়ীত
আয়ম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্য বিদ্ধি।।
            (মুণ্ডক উপনিষদ, ২/২/৩)

অনুবাদঃ— হে সোম্য, উপনিষদে প্রসিদ্ধ মহান্ত্র ধনু গ্রহণ করিয়া উহাতে সতত-চিন্তাদ্বারা তীক্ষ্ণীকৃত বাণসন্ধান করিবে, ধনু আকর্ষণপূর্বক লক্ষ্যে চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া লক্ষ্য সেই অক্ষরকেই ভেদ কর।


প্রণবো ধনুঃ শরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ।
           (মুণ্ডক উপনিষদ, ২/২/৪)

অনুবাদঃ— ওঙ্কারই ধনু, জীবাত্মাই শর, ব্রহ্ম উক্ত শরের লক্ষ্য বলিয়া কথিত হন। প্রমাদহীন হইয়া লক্ষ্য ভেদ করিতে হইবে। অতঃপর শরের ন্যায় তন্ময় (লক্ষ্যের সহিত অভিন্ন) হইবে।


যস্মিন্ দৌঃ পৃথিবী চান্তরিক্ষম্ ওতং মনঃ সহপ্রাণৈশ্চ সর্বৈঃ তমেবৈকং
 জানথ আত্মানম্ অন্যা বাচো বিমুঞ্চথামৃতসৈ্যষ সেতুঃ।
          (মুণ্ডক উপনিষদ, ২/২/৫)

অনুবাদঃ— যাঁহাতে দ্যুলোক, পৃথিবী ও অন্তরিক্ষ এবং ইন্দ্রিয়বর্গসহ অন্তঃকরণ সমর্পিত আছে (মনুষ্য ও প্রাণীগণের)। সেই অদ্বিতীয় আত্মাকেই অবগত হও এবং অনন্তর অপর সকল বাক্য ত্যাগ কর। এই আত্মজ্ঞানই মোক্ষপ্রাপ্তির উপায়।


অরা ইব রথনাভৌ সংহতা যত্র নাড্যঃ স এষোহন্তশ্চরন্তে বহুধা জায়মানঃ।
ওমিত্যেবং ধ্যায়থ আত্মানং স্বস্তি বঃ পারায় তমসঃ পরস্তাৎ।।
           (মুণ্ডক উপনিষদ, ২/২/৬)

অনুবাদঃ— চক্রশলাকা যেরুপ রথচক্রের নাভিতে অবস্থিত থাকে সেইরুপ নাড়ীসমূহ যে হৃদয়ে সম্প্রবিষ্ট আছে, সেই হৃদয়মধ্যে উক্ত পুরুষ নানারুপে প্রতীত হইয়া বর্তমান আছেন। উক্ত আত্মাকে ওঙ্কার অবলম্বনপূর্বক ধ্যান কর। অজ্ঞানান্ধকারের অতীত পরপারে গমনের জন্য তোমাদের স্বস্তি হউক।
                       
  মনুসংহিতা

ওঙ্কারপূর্বিকাস্তিস্রো মহাব্যাহৃতয়েহিব্যায়াঃ
ত্রিপদা চৈব সাবিত্রী বিজ্ঞেয়ং ব্রহ্মণো মুখম।।
              (মনুসংহিতা, ২/৮১)

অর্থাৎ— পূর্বে ওঙ্কার এবং অবিনাশী মহাব্যাহৃতি (ভূঃ,ভুবঃ,স্বঃ) উচ্চারণপূর্বক ত্রিপদী গায়ত্রী হল ব্রহ্ম প্রাপ্তির একমাত্র উপায় বলে জানবে।


গীতায়

ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মামনুস্মরন্ ।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্ ।।
                   (গীতা, ৮/১৩)

অর্থঃ— ॐ (ওঁ) এই একাক্ষর ব্রহ্ম উচ্চারণপূর্বক করতে করতে এবং তার অর্থস্বরূপ নির্গুণ ব্রহ্মরূপ আমাকে স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন তিনি পরমগতি অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্ত হন।

ॐ ওঙ্কার বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা ও গীতা অনুযায়ী মহামন্ত্র হিসাবে পূজিত। ওঁ উচ্চারণ সবাই করতে পারে। ওঁ উচ্চারণ পারে না এমন কোন মানুষ নেই। তাই সনাতন ধর্মে একটাই মহামন্ত্র কেবল ওঙ্কার।

ॐ ওঙ্কার একটি মহামন্ত্র তাহাকে সকলে অবলম্বন কর।


ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ

জয় শ্রীরাম
হর হর মহাদেব
 SVS
চট্টগ্রাম বিভাগীয় এক্টিভ কর্মী
শ্রী বাবলু মালাকার
(সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, চট্টগ্রাম)

নবীনতর পূর্বতন