বেদান্তের অধিকারীর মধ্যে অন্যতম হলো প্রায়শ্চিত্ত। অর্থাৎ নিজের পাপকর্মকে স্মরণ করে কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া। এই অনুতপ্ত বোধই অনেক বড় বড় চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীকে সাধুসন্তে রূপান্তরিত করেছে। রামায়ণের রত্নাকর দস্যুর কাহিনী আমরা সকলেই জানি। এই রত্নাকর দস্যুই নিজের পাপবোধের উপলব্ধি থেকে মহর্ষি বাল্মীকিকে পরিণত হয়ে রামায়ণ লিখেছিলেন।
আমরা কেউই অনন্ত পাপি বা অনন্ত পুণ্যবান নয়। সুখেদুঃখে, আনন্দবেদনায় মানুষ আমরা। সত্ত্ব, রজঃ, তম এ ত্রিগুণ দ্বারা আছন্ন আমরা। আমরা কেউ এর ঊর্ধে নই।একমাত্র ভগবানই ত্রিগুনাতীত। এ তিনটি গুণ তিনটি পিঠাপিঠি বোনের মতো একে অন্যকে জরিয়ে থাকে। এরা ঝগড়া করবে, মারামারি করবে, চুলাচুলি করবে আবার একসাথে মজা করে তেঁতুল খাবে। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তেমনিভাবে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই এ ত্রিগুণ বা ত্রিগুণের সমন্বয় আছে এবং এ সমন্বয় থেকেই ভাল, মধ্যম ও খারাপের উৎপত্তি।
যিনি সাধু-সন্ত তার প্রধান গুণ যেমন সত্ত্বগুণ এবং সত্ত্বগুণ থেকে উদ্ভূত লোককল্যাণকামী চিন্তা। তেমনি তার মধ্যেও রজোগুণ, তামসিক গুণও আছে বা থাকতে পারে।সাধুসন্তের ভোগসর্বস্ব অলস গদিবালিসে আরামে থাকার মানসিকতা উৎপন্ন হয় রাজসিক গুণের প্রভাব থেকে। এবং নিজেকে জাহির করা, আত্মপ্রচার, অন্যান্য
সাধুসন্তদের প্রতি ঈর্ষা, শিষ্যদের দিয়ে নিজেকে অবতার বলে প্রচার করিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের পদ্মের উপরে বসা বিভিন্ন সংভংচং মার্কা ছবি প্রচার হলো তামসিক গুণের লক্ষণ।
সাধুসন্তদের প্রতি ঈর্ষা, শিষ্যদের দিয়ে নিজেকে অবতার বলে প্রচার করিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের পদ্মের উপরে বসা বিভিন্ন সংভংচং মার্কা ছবি প্রচার হলো তামসিক গুণের লক্ষণ।
ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে যেমন ব্রহ্ম আছে, তেমনি প্রত্যেকটি জীব পরিশেষে ব্রহ্মময় হয়েই জন্মজন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্তি লাভ করবে। আমাদের সাত্ত্বিক কর্ম এবং কর্মপ্রচেষ্টাই আমাদের মুক্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়।
যেহেতু ত্রিগুণ দ্বারা আমরা সবাই আচ্ছন্ন তাই আমরা চাই বা না চাই পাপ আমাদের মোহাচ্ছন্নতা তৈরি করে মুগ্ধ করে। আমরা তখন জলের মধ্যে বাস করেও তৃষ্ণাতুর হয়ে যাই। জল তৃষ্ণায় আমাদের বুক ফেটে যায়। অজ্ঞানতা আমাদের বুদ্ধি লোপ করে দেয়। আকাশে হঠাৎ মেঘ করলে যেমন সূর্য ঢাকা পরে যায়, আবার মেঘ সরে গেলে সূর্য জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাবসত অনেক সময় না বুঝেশুনেই ঈশ্বরের বা দৈবশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলি।কিন্তু পরে যখন অনুতাপ নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত বোধ নিয়ে ঈশ্বরের অহেতুকী স্মরণ নেই তখনই ধীরেধীরে আমাদের হৃদয়ের অজ্ঞান নাশ হতে হতে ব্রহ্মজ্ঞানের, ব্রহ্মপ্রেমের উদয় হয়। এ বিষয়ে বেদে একটি অসাধারণ মন্ত্র আছে-
আপাং মধ্যে তস্থিবাংসং তৃষ্ণাবিদব্জরিতারম্।
মুলা সুক্ষত্র মৃলয়।।
যৎকিং চেদং বরুণ দৈব্যে জনঃ
অভিদ্রোহং মনুষ্যাশ্চরামসি।
অচিত্তী যত্তব ধর্মা যুরোপিম
মা নস্তস্মাদেনসো দেব রীরিযঃ।।
( ঋগ্বেদ : ৭. ৮৯. ৪-৫)
হে ভগবান, জলমধ্যে বাস করেও তৃষ্ণার্ত আমি। হে সুক্ষত্র বরুণদেব, দয়া কর, দয়া কর ; আমরা সাধারণ মনুষ্য, দেবগণের সম্বন্ধে আমরা যা কিছু বিরুদ্ধাচরণ করেছি অজ্ঞানতাবশত, সে সকল পাপ থেকে আমাদের মুক্ত করে দাও ; হে ভগবান, তোমার বাৎসল্য প্রেম থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই।
তাই বেদান্ত চর্চা, নিষ্কাম কর্ম, ইন্দ্রিয় সংযম, সত্ত্বগুণের অভ্যাস, নিত্য এবং নৈমিত্তিক উপাসনা, প্রায়শ্চিত্ত বোধ, সর্বদা ব্রহ্মানুভূতি বেদান্তের এ সকল মূখ্যবিষয়ের অনুশীলন সর্বদা নিরবচ্ছিন্নভাবে করা উচিৎ ; তবেই দেহের মধ্যেই অবস্থিত মুক্তির অশ্বত্থবৃক্ষটি ধীরেধীরে বিস্তার লাভ করে অনন্তে যুক্ত হবে।
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী