আমরা সকলেই মোক্ষলাভের ব্যাকুলতায় উৎসুক। কিন্তু সেটা প্রাপ্ত করতে হলে যা করতে হবে তা করি না। তাই আত্মার উন্নতিও হয় না।
সন্ন্যাস ও ত্যাগের বিষয়ে অন্যান্য দার্শনিকদের চারটি মতঃ—
১) কিছু বিদ্বান ব্যক্তি কাম্য কর্ম ত্যাগ করাকেই সন্ন্যাস বলেন।
২) কেউ আবার সমস্ত কর্মফল ত্যাগ করাকেই ত্যাগ বলেন।
৩) কে কেউ বলর থাকেন কর্মকর দোষযুক্ত মনে করে ত্যাগ করা উচিত।
৪) অপর কেউ বলেন যজ্ঞ, দান ও তপস্যারূপ কর্ম ত্যাগ করা উচিত নয়।
⚪👉 গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় ব্যাখা সন্ন্যাস (সাংখ্যযোগ) — (কর্মযোগ) ও মোক্ষলাভের যোগীদের করণীয়ঃ—
⚫➡ যোগী হতে হলে যথার্থ রুপে ত্যাগ, জ্ঞান, কর্তা, বুদ্ধি, ধৃতি, সুখ এগুলোকে জানার প্রয়োজন। নাহলে কেবল মন্ত্র পাঠ করেই যাব তা আর কোনদিনও কাজে আসবে না।
⚪👉 ত্যাগ কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ ত্যাগ ৩ প্রকার।
১। তামসিক ত্যাগঃ— স্বধর্মরূপে নির্দিষ্ট কর্ম কারোরই উচিত নয়। নিত্যকর্ম ত্যাগ মোহবশত এগুলো ত্যাগ করলে তাকে বলা হয় তামস ত্যাগ । (গীতা ১৮/৭)
২। রাজসিক ত্যাগঃ— কর্তব্য–কর্ম পালনে শুধুমাত্র দুঃখই হয় —এই ভেবে শারীরিক কষ্টের ভয়ে যে কর্ম ত্যাগ করা হয়, তাকে বলে রাজসিক ত্যাগ এরূপ কর্মত্যাগীর ত্যাগের ফল যে শান্তি, তা প্রাপ্তি হয় না। নিত্যকর্মকে দুঃখজনক মনে করে ত্যাগ করাকে রাজসিক ত্যাগ বলে। (গীতা ১৮/৮)
৩। সাত্ত্বিক ত্যাগঃ—স্বধর্ম (নিয়ম কর্ম) পালন করা মানুষের অবশ্য কর্তব্য— এই মনে করে কর্মের আসক্তি ও কর্মফল ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে নিত্যকর্ম করা। কর্মফল ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে নিয়ত (স্বধর্ম) কর্ম পালন করাই হল সাত্ত্বিক ত্যাগ। (গীতা ১৮/৯)
তাই কর্মত্যাগ করলে যোগী হওয়া যায় না। কর্মফল ত্যাগ করতে হবে আসক্তিশূণ্য হয়ে।
যিনি দ্বেষ বর্জন করে সকাম ও নিষিদ্ধ কর্মত্যাগ করেন এবং আসক্তিরহিত হয়ে শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্তব্য—কর্ম পালন করেন এরূপ বুদ্ধিমান ত্যাগী ব্যক্তি নিঃসন্দেহে নিজ স্বরূপে স্থিত রয়েছেন। (গীতা ১৮/১০)
বিহিত কর্ম ও নিয়ত (শাস্ত্র নির্দিষ্ট) কর্মে পার্থক্য কিঃ—
শাস্ত্রর যেসব কর্ম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলিকে বলা হয় বিহিত কর্ম। সেইসব বিহিত কর্ম সামগ্রিকরূপে কোনও এক ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়; কেননা শাস্ত্রে সমস্ত বার ও তিথিতে ব্রত পালনের বিধান আছে। যদি কোনও এক ব্যক্তি এইসব বার ও তিথিগুলির ব্রত পালন করেন, তাহলে তিনি আহার করবেন কবে? এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে মানুষের পক্ষে সমস্ত বিহিত কর্ম করা সম্ভব নয়। কিন্তু ওই বিহিত কর্মেও বর্ণ, আশ্রম ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যার জন্য যে কর্তব্য প্রয়োজন, তার পক্ষে সেটিই নিয়ত কর্ম বা স্বধর্ম বলা হয়।
যেমনঃ— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের যে যে বর্ণের জন্য জীবিকা ও শরীর—নির্বাহের যেসব নিয়মাদি আছে, সেই সেই বর্ণের জন্য সেগুলিই "নিয়তকর্ম" বা "স্বধর্ম।
⚪👉 জ্ঞান কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ জ্ঞান ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক জ্ঞানঃ— যে জ্ঞানের দ্বারা সাধক সর্বপ্রকার সমস্ত প্রাণীর মধ্যে বিভাগরহিত এক অবিনাশী সেই অভিবক্ত চিন্ময় আত্মাকে দর্শন করেন, সেই জ্ঞানকে বলা হয় সাত্ত্বিক জ্ঞান। (গীতা ১৮/২০)
২। রাজসিক জ্ঞানঃ— যে জ্ঞানের মানুষ পৃথক পৃথক দ্বারা সমস্ত প্রাণীতে ভিন্ন আত্মাকে অবস্থিত বলে পৃথক পৃথকভাবে রূপের দর্শন হয় তাকে বলে রাজসিক জ্ঞান। (গীতা ১৮/২১)
৩ । তামসিক জ্ঞানঃ— যা উৎপন্ন হওয়া শরীরেই পূর্ণের মতো করে আসক্ত এবং যা যুক্তিসংগত নয়, তাত্ত্বিক জ্ঞানরহিত ও তুচ্ছ, সেই জ্ঞান হল তামসিক জ্ঞান।।
➡ যে জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃত তত্ত্ব অবগত না হয়ে একটি বিশেষ কার্য পরিপূর্ণ করার আসক্তির উদ্ভব হয়। সেই তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে। (গীতা ১৮/২২)
⚪👉 কর্ম কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ কর্ম ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক কর্মঃ— যে নিয়ত (নির্দিষ্ট) কর্ম ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত মানুষের দ্বারা রাগ (আসক্তি) — দ্বেষ ও কর্তৃত্বাভিমান রহিত হয়ে করা হয় তাকে বলে সাত্ত্বিক কর্ম।
২। রাজসিক কর্মঃ— যে কর্ম ভোগেচ্ছাযুক্ত মানুষের দ্বারা অহংকার অথবা পরিশ্রমপীর্বক শুরু করা হয় তাকে রাজসিক কর্ম বলে।
৩। তামসিক কর্মঃ— যে কর্ম পরিণাম, ক্ষতি, হিংসা ও নিজ সামর্থ্য না বুঝে মোহপূর্বক আরম্ভ করা হয় তাকে তামসিক কর্ম বলে।
⚪👉 কর্তা কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ কর্তা ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক কর্তাঃ— যে ব্যক্তি আসক্তিরহিত, অহং—অভিমানবর্জিত, ধৈর্য ও ইৎসাহযুক্ত এবং কর্মের সিদ্বি ও অসিদ্ধিতে নির্ববকার থাকেন, তিনিই হলেন সাত্ত্বিক কর্তা।। যে সমস্ত জড় বাসনা থেকে মুক্ত, অহংকারশূন্য, উৎসাহি এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে নিরাকার এই রুপ কর্তাকে সাত্ত্বিক কর্তা বলে। (গীতা ১৮/২৬)
২। রাজসিক কর্তাঃ— যে ব্যক্তি রাগী (আসক্ত), কর্মফলাকাঙ্ক্ষী, কর্মসক্ত, লোভী, হিংসুক, অপবিত্র অশুদ্ধ অশুচি ও হর্ষ—শোকযুক্ত যে কর্তা তাকে রাজসিক কর্তা বলা হয়। (গীতা ১৮/২৭)
৩। তামসিক কর্তাঃ— যে ব্যক্তি অসতর্ক, কর্তব্যাকর্তব্য শিক্ষাবর্জিত, জেদী, একগুঁয়ে, কৃতঘ্ন, অলস বিষাদী ও দীর্ঘসূত্রী, তাকে বলা হয় তামসিক কর্তা।। যে অনুচিত কার্যপ্রিয়, জড় চেষ্টাযুক্ত, অনম্র, শঠ, অন্যের অবমাননাকারী, অলস, বিষাদীযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী যে কর্তা তাকে তামসিক কর্তা বলে। (গীতা ১৮/২৮)
⚪👉 বুদ্ধি কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ বুদ্ধি ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক বুদ্ধিঃ— যে বুদ্ধির দ্বারা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি, কার্য ও অকার্য, ভয় ও অভয়, বন্ধন ও মুক্তি এই সকলের পার্থক্য জানতে পারা যায় তাকে সাত্ত্বিক বুদ্ধি বলে। ১৮/৩০
২। রাজসিক বুদ্ধিঃ— যে বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম ও অধর্ম, কার্য ও অকার্য ইত্যাদির পার্থক্য অসম্যক রুপে জানতে পারা যায় সেই বুদ্ধিই রাজসিক। ১৮/৩১
৩। তামসিকঃ— যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম এবং সমস্ত বস্তুকে বিপরীত বলে মান্য করে তমসাবৃত সেই বুদ্ধিই তামসিক। ১৮/৩২
⚪👉 ধৃতি কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ ধৃতি ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক ধৃতিঃ— যে অব্যভিচারিণী ধৃতি যোগ অভ্যাস দ্বারা মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয় ক্রিয়া সকলকে ধারণ করে সেই ধৃতিই সাত্ত্বিক। ১৮/৩৩
২। রাজিসক ধৃতিঃ— যে ধৃতি ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ধর্ম, অর্থ ও কামকে ধারণ করে সেই ধৃতিই রাজসিক। ১৮ /৩৪
৩। তামসিক ধৃতিঃ— যে ধৃতি স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ, মদ ইত্যাদি ত্যাগ করে না সেই বুদ্ধিহীন ধৃতিকেই তামসিক। ১৮/৩৫
⚪👉 সুখ কত প্রকার ও কি কিঃ—
⚫➡ সুখ ৩ প্রকার।
১। সাত্ত্বিক সুখঃ— যে সুখ প্রথমে বিষের মতো কিন্তু পরিণামে অমৃততুল্য এবং আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির নির্মলতা থেকে জাত, সেই সুখকে সাত্ত্বিক সুখ বলে। ১৮/৩৭
২। রাজসিক সুখঃ— বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সুখ প্রথমে অমৃতের মতো এবং পরিণামে বিষের মতো অনুভূত হয় তাকে রাজসিক সুখ বলে। ১৮/৩৮
৩। তামসিক সুখঃ— যে সুখ প্রথমে ও শেষে আত্মার মোহজনক এবং যা নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ থেকে উৎপন্ন হয় তা তামসিক সুখ বলে কথিত হয়। ১৮/৩৯
যোগী হতে হলে অবশ্যই উপরুক্ত বিষয় বিষয়গুলো জানতে হবে। সেগুলো থেকে সাত্ত্বিকতা গ্রহন করতে হবে।
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
সনাতন ধর্ম হলো আদি, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। মূলত সনাতন ধর্ম হলো জ্ঞান ও গুনের সুন্দর সমন্বয় যা চিরন্তন সত্য। জীবের ও প্রকৃতির নিয়মের চিরন্তন প্রকাশ হলো সনাতন ধর্ম। আমার ক্ষুদ্র চেষ্টায় আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা করেছি এবং সেটা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি।
শ্রী বাবলু মালাকার