কলিযুগে কি বেদ নিষিদ্ধ ? জানুন প্রকৃত সত্য কি।



বাংলার ভাগবত পাঠক এবং কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধের অসার প্রোপাগান্ডা। বর্তমানে কিছুকিছু সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গানের বই, পাঁচালী, কথোপকথনের বই এবং চিঠিপত্রাদি সংকলনগ্রন্থকে যারযার ব্যক্তিগত গুরুবাদী বিশ্বাস থেকে প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ মনে করেন; তারা নিজেরাও জানেন না যে এ কাজের মাধ্যমে ধীরেধীরে তারা অজ্ঞাতসারে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন । বেদবিদ্যা সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা না থাকায় তাদের সুবুদ্ধির দরজা দিনেদিনে তালাবন্ধ জড়তাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।


বেদের পরে রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এগুলির একটিও প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়।বেদই আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এবং পুরাণগুলিকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। পুরাণে যেমন অনেক অসাধারণ অসাধারণ কথা আছে, তেমনি কিছু কিছু স্থানে বালখিল্য কথাও আছে। আবার পুরাণের সামান্য দুইএকটা বালখিল্য অসার উদাহরণ দেখিয়ে কিছুকিছু কুতার্কিক বিশেষ করে দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুগামীরা সকল পুরাণকেই বাদ দেয়ার মতো ধৃষ্টতা করেন।
পুরাণের জগতে শ্রীমদ্ভাগবত, মার্কণ্ডেয়, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, অগ্নি, শিব, স্কন্ধ এই অসাধারণ পুরাণগুলি যেমন আছে, তেমনি ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য এই পুরাণগুলিও আছে।

ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য সহ এমন আরো কিছু পুরাণ আছে, যেগুলি পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই পুরাণগুলিতে বিভিন্ন সময়ে কিছু সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী এবং তুর্কিশাসকদের হাতের কাটাছেড়া হয়েছে। কাটাছেড়া হওয়ার পরেও এ পুরাণগুলি সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে রাজহংস যেমন দুধেজলে মিশানো থাকলে শুধুমাত্র জলের অংশকে পরিত্যাগ করে দুধটুকুই গ্রহণ করে; এ রাজহংসের মতো আমাদেরও পুরাণগুলি থেকে প্রয়োজনীয় সকল সারবস্তুগুলি নিয়ে অসার বস্তুগুলি পরিত্যাগ করতে হবে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার পূর্ণতা পেয়েছে পুরাণগ্রন্থে। বৈদিক জ্ঞানই সাধারণের উপযোগী করে গল্পের ছলে পৌরাণিক কথাকাহিনীতে বোঝানো হয়েছে।

বর্তমানেকালে কিছু ভাগবত পাঠকেরা বিভিন্ন স্থানে ভাগবত পাঠ করতে এসে প্রথমেই কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ সহ অনেক আকডুম, বাকডুম কথা বলে শব্দ দ্বারা বাতাসকে দুষিত করতে থাকেন ; আমি ঠিক জানিনা তারা এই কথাগুলি বুঝে বলে না বুঝে বলে?
সেই সকল পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তিদের একটু শ্রীমদ্ভাগবতে বেদ সম্পর্কে কি কি বলা আছে তা একটু পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো:

"যে ব্যক্তি অকারণে বেদাচার ছেড়ে অনাচারে প্রবৃত্ত হয়, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নরকে নিয়ে গিয়ে কশা (চাবুক) দিয়ে মারতে থাকে। মার খেয়ে ছুটে পালাতে গেলে দুপাশে তালবনের অসিপত্রে (তরোয়ালের মতো ধারাল পাতায়) সেই পাপির সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয় ; আর সে 'হা হতো অস্মি' ( আমি মরলাম) বলে দারুণ যন্ত্রণায় পদে পদে জ্ঞান হারায়। স্বধর্ম ত্যাগ করলে এমন শাস্তিই ভোগ করতে হয়।"
(শ্রীমদ্ভাগবত: ৫ম স্কন্ধ, ছাব্বিশ অধ্যায়)

"বেদে যা কর্তব্য বলে বলা আছে একমাত্র তাই ধর্ম, এর বিপরীত যা অর্থাৎ বেদে যা নিষিদ্ধ তা সকলই অধর্ম। বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণের নিঃশ্বাস থেকে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছে, তাই বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণ এবং স্বয়ম্ভু।"
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৬ষ্ঠ স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়)

"অগ্নি যেমন আকাশে তপ্ত অবস্থায় অতি সূক্ষ্মরূপে থাকে এবং কাষ্ঠে সবলে মন্থন করলে বায়ুর সহায়তায় প্রথমে অণুরূপে অর্থাৎ সূক্ষ্ম বিস্ফুলিঙ্গাদি রূপে উৎপন্ন হয়ে, পরে প্রকৃষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে ঘৃতসংযোগে পরিবর্ধিত হয়, তেমনি বেদরূপা বাণীও স্থূলসূক্ষ্মরূপে আমারই অভিব্যক্তি বলে জানবে।"
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১১শ স্কন্ধ, দ্বাদশ অধ্যায়)

এ জাজ্বল্যমান রেফারেন্স দেখেও কিছু লোক না বুঝে কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ নামক আকডুম, বাকডুম বকে যাচ্ছেন আমৃত্যু। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রশ্ন, ভাই কলিযুগে যে বেদ নিষিদ্ধ এটা কি বেদে কোথাও ভগবান বলেছেন যে, আমার এই বৈদিক জ্ঞানটি সত্য, ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগের জন্যে ; কলিযুগে তোমরা শুধুমাত্র তোমাদের যারযার কানে ফুশমন্ত্র দেয়া বাবা-গুরুদের গ্রন্থই একমাত্র পড়বে। না ভগবান এমন কথা বলেননি। তাহলে এই কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধের কথাগুলি কোথায় আছে? আছে বিভিন্ন মানুষপূজারী বাবা,গুরু, তথাকথিত অবতার, ধর্মব্যবসায়ী এবং কিছু পেশাজীবী গীতা-ভাগবত পাঠকদের কথাবার্তা ও গ্রন্থে।

এখনও কি আমাদের সময় হয়নি সকল বেদবিরুদ্ধ বাবাসর্বস্ব মতগুলিকে পচা ডোবায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুতই বৈদিক রাজমার্গে ফেরার?
আমাদের উচিৎ, সকলের নিজ সন্তানদের মাথাটাকে ছোট থাকতেই বেদ এবং বেদান্তের জ্ঞানরূপ গঙ্গাজল দিয়ে পূর্ণ করে দিতে; যাতে তারা যখন বড় হবে তখন কেউ যেন তাদের মাথায় ড্রেনের নোংরা পূতিগন্ধযুক্ত দুষিত জল ঢেলে দিয়ে তাদের অমানুষ তৈরি করে বাবা-মা, আত্মীয়পরিজন থেকে দূরে ঠেলে দিতে না পারে।

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ
নবীনতর পূর্বতন