যে হিন্দু মহামানবের হাতে অনুবাদিত হয়েছিল প্রথম বাংলা আল কোরআন।


পুরো লেখাটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিনোদন ওয়েবসাইট এগিয়ে চলো ডট কমের মাশরুফ হোসাইন এর লেখা থেকে নেওয়া।
লোকটার জন্ম আজ থেকে পৌনে দুশ বছর আগে, নরসিংদীতে। সেই যুগে প্রচন্ড গোঁড়াপন্থী একটা সমাজে জন্ম নিয়েও লোকটার মাথায় কি এক ভূত চাপলো, সম্পূর্ণ বিজাতীয় একটা ভাষা শেখা শুরু করল সে। সেই যুগে গুগল ছিলোনা, বই ছিল হাতে গোনা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা একটু দুরে হলেই মাসখানেক লেগে যেত। ভাষা শেখার জন্য সে লক্ষ্ণৌ গেল, ফিরে এসে ছোটখাটো চাকুরি শুরু করল। কিন্তু জ্ঞানের নেশা যার, তাকে কি আর চাকুরি দিয়ে আটকানো যায়? নিজে নিজেই গবেষণা শুরু করল সে।
সেই সময়ে ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করাকে অনেকে খুব খারাপ চোখে দেখত। সামাজিক বাস্তবতায় এই কাজটা করা খুবই সাহসের কাজ ছিল, আর অন্য ধর্মের লোক হলে তো কথাই নেই! লোকটা তাই ভয়ে ভয়ে নিজ নাম গোপন রেখে বিশ্বের একটা প্রধান ধর্মগ্রন্থের অল্প কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করল। 
এই অনুবাদ সেই ধর্মাবলম্বীদের কাছে এতই জনপ্রিয় হল যে তাদের ধর্মীয় পন্ডিতরা এই অনুবাদকের নাম প্রকাশ করতে অনুরোধ করলেন। ভিন্ন ধর্মের লোক হলেও অনুবাদককে তারা সম্মান দিয়ে “ভাই” বলে ডাকা শুরু করলেন। সারাটা জীবন এই লোকের নামের আগে “ভাই” উপাধি বসে গিয়েছিল, যা আজও আছে।
প্রিয় পাঠক, সম্ভবত বুঝে ফেলেছেন কার কথা বলছি।
জ্বি, লোকটার নাম ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। যে ধর্মগ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছিলেন সেটির নাম পবিত্র কুরআন শরীফ। তাঁর অনুবাদ বাংলা ভাষায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক কুরআন অনুবাদ। হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া এই লোক সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এই অমূল্য কাজটি করেছিলেন। অনেকেই জানেন না, কুরআন শরিফের অনুবাদ ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের একমাত্র কাজ না। সারাটা জীবন এই মহামনীষী কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলা ভাষায় ইসলামী গ্রন্থ অনুবাদের কাজে। ছিয়ানব্বই জন মুসলমান দরবেশের জীবনী “তাজকিরাতুল আউলিয়া”, সুফী সাধক জালালুদ্দিন রুমীর মহাগ্রন্থ “মসনভী”, সিহাহ সিত্তাহের অন্যতম হাদীস মিশকাত শরীফের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, নবীজী(স) এর জীবনী, চার খলিফার জীবনীসহ প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ বাংলাভাষী মুসলমানগন এই মহাত্মার গুণে নিজ মাতৃভাষায় পড়তে পেরেছিলেন।
ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের অনূদিত কুরআন শরীফ সৌভাগ্যক্রমে আমার হাতে এসেছে। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েছি এবং শিহরিত হয়েছি প্রতি ছত্রে ছত্রে কি অসাধারণভাবে কুরআন শরীফের ভাবগাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে সেটি দেখে। আমার মত আরবি না জানা সাধারণ পাঠক যারা, তারা যদি একটু কষ্ট করে পড়ে দেখেন, বুঝতে পারবেন আমি কি বোঝাতে চাইছি। অন্য যে কটি সরল বাংলা অনুবাদ হাতের কাছে পেয়েছি, সেগুলোর ভাষা একটু সহজ হলেও পবিত্র কোরানের যে ঝংকার, পড়ার সময় যে অনুভূতি- সেটি গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদের ধারেকাছেও না। আমি বলছি না যে অন্য অনুবাদগুলো খারাপ( ওটা বলার মত জ্ঞানও আমার নেই)। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদ এবং টীকাটিপ্পনী পড়ে আমার যে অনুভূতি, সেটাই প্রকাশ করছি মাত্র। 
চলুন, সে যুগের আলেম সমাজ কি বলেছেন দেখে নিই:

“আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদের আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়।”
“কুরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণ সমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমন্ডলীয় এতোদৃশ্য উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইবেন, তখন সেই সকল লোকের নিকট আত্ন-পরিচয় দিয়া তাঁহার উপযুক্ত সম্ভ্রম করা উচিত।”
ব্যথিত হই, যখন দেখি এ যুগের লোকেরা শুধুমাত্র নামের শেষে “সেন” হবার কারণে এই মহামনীষীর নামে কুৎসা রটায়। কেউ কেউ টিটকিরি দিয়ে বলে, “এত জ্ঞান নিয়ে কি লাভ, যাবে তো জাহান্নামেই কারণ সে হেদায়েত পায় নাই।” আমরা ভুলে যাই, কে হেদায়েত পেয়েছে কে পায়নি, কে জান্নাতে আর কে জাহান্নামে যাবে এইটা ঠিক করার মালিক আমরা কেউ না। মালিক হচ্ছেন তিনি, যিনি মহাত্মা গিরিশ চন্দ্র সেনকে এই পরিমান জ্ঞান দিয়েছিলেন। একমাত্র তিনিই জানেন কার কপালে কি আছে। 
জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ বলে জানি। আর কিছু না হোক, এই কারণেই গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদটি পড়া জরুরী। 
আমার শ্রদ্ধা নিন, হে মহামনীষী!
নবীনতর পূর্বতন