ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত চরিত্র ও শিক্ষা

৫২৪৫ বছর পূর্বে এই ভূখণ্ডে জন্মে ছিলেন এক যোগেশ্বর, সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ, পরমেশ্বরের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। একজন আর্দশ নেতা, রাজনীতিক, রাষ্ট্রজ্ঞ, ধর্মসংস্থাপক এবং মুক্তিদাতা। ধর্মরাজ্য সংস্থাপক শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বহুগ্রন্থে বহু রকমের কথা বলে তার জীবনকে পৌরাণিক, অলৌকিক ও কিছুটা অবিশ্বাস্য করে তোলা হয়েছে।

আরো পড়ুন - জন্মাষ্টমী কি ও কেন!

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী প্রধানত তিনটি গ্রন্থে পাওয়া যায় :

১.ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবন যাকে আমরা ধর্মসংস্থাপন বলি, সেই ধর্মসংস্থাপনের কথা পূর্ণাঙ্গভাবে আছে মহাভারতে।

২. তাঁর যদুবংশের সকল কথা এবং ঘটনাবলী পাওয়া যায় মহাভারতের খিলকাণ্ড হরিবংশে।

৩. এবং তাঁর বাল্যকাল থেকে তিরোধান (অবতার লীলা সম্বরণ) পর্যন্ত সকল কথা আছে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে।

যেসকল গ্রন্থে বড় পরিসরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা পাওয়া যায় সেগুলি হলো-

ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বায়ুপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, কূর্মপুরাণ, বামনপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ একাধিক পুরাণে। এমনকি বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকেও একাধিক স্থানে, কিছু কিছু স্থানে বিকৃতভাবেও শ্রীকৃষ্ণের কথা পাওয়া যায়। তবে পুরাণগুলির মধ্যে পদ্ম এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এই দুটি পুরাণের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি পাওয়া না যাওয়ায় ; বর্তমানে পদ্ম এবং ব্রহ্মবৈবর্ত নামে যে গ্রন্থদুটি পাওয়া যায় সেটি অনেকটাই বিকৃত হয়ে যাওয়া এবং সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যায় গ্রন্থদ্বয়ের অনেকটা অংশই যে প্রক্ষিপ্ত।

তবে ব্রহ্মপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ নামক এই দুটি পুরাণে বিস্তৃতভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণিত আছে।

বৈষ্ণব মতের অন্যতম ভিত্তি হলো শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণু পুরাণ নামক গ্রন্থদ্বয় । এর মধ্যে রূপে, রসে, মাধুর্যে আমাদের আঠারোটা পুরাণের মধ্যে অনন্য অসাধারণ হলো শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। এ পুরাণটি জীবের সকল মালিন্য নাশ করে দেয়, তাই তাঁর আরেক নাম অমল পুরাণ। দ্বাদশ স্কন্ধে বিভক্ত ৩৩৫ টি অধ্যায় সম্বলিত প্রায় ১৮০০০ শ্লোকের সমন্বয়ে এ পুরাণ। প্রধানত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত, অবতারতত্ব ও শ্রীকৃষ্ণরূপী পরমাত্মা বিষ্ণুর মাহাত্ম্য আলোচিত হলেও পুরাণের পঞ্চ লক্ষণসমন্বিত সকল প্রকার উপাদান এ গ্রন্থের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অসাধারণ তার ধ্বনিমাধুর্য এবং পদলালিত্য। শ্রীমদ্ভাগবতের বিশেষ বার্তা হলো-

  • অচিন্ত্য ভগবান সর্বত্র আছেন।
  • তিনি জীবের কল্যাণে অবতাররূপে আসেন।
  • তিনি তাঁর সন্তানদের কাছে ডাকেন,ভালবাসেন এবং রক্ষা করেন সকল বিপদ থেকে।
  • তিনি হলেন ভাবনার মধ্যে ভাবনাতীত।
  • তিনি পরম সুন্দরতম এবং শ্রবণমঙ্গলময় তাঁর বাক্য।

বৈদিক জ্ঞানের কথাই শ্রীভাগবতে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই শ্রীমদ্ভাগবত নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন ' নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং' অর্থাৎ বৈদিক কল্পতরুরূপ জ্ঞানবৃক্ষের পাকা টসটসে রসালো ফল বলে। শ্রীমদ্ভাগবতের শুরুতেই এই প্রাণমাতানো কথাগুলো বলা আছে :

"মহামুনি বেদব্যাস-কৃত এই শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে অহংকার শুন্য সাধুপুরুষদের উপযোগী করে ফলাকাঙ্ক্ষারহিত পরমধর্মের কথা বলা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাঝেই ত্রিতাপনাশক পরমসুখকর বস্তুর জ্ঞান নিবদ্ধ আছে। অন্য কোথাও আর এমনটি নেই। তাই সজ্জন ব্যক্তিরা শ্রীমদ্ভাগবতে সদা মনোনিবেশ করলে শ্রীভগবান তাদের নিকটে সহজেই ধরা দেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত চরিত্র, শ্রীকৃষ্ণের জীবনী, শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণের জীবনী

ওগো পৃথিবীর রসিক- ভাবুক মানুষেরা, বেদ যেন এক কল্পতরু (এমন একটি বৃক্ষ, তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়) ; তা থেকে উদ্ভূত এই ভাগবত-ফল শুকদেবের শ্রীমুখে পড়ে অমৃতরসে সিক্ত হয়ে ওঠে। তারপর সেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই শ্রীমদ্ভাগবত রস তোমরা ব্রহ্মে লীন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম আস্বাদন করে চলো।"

( শ্রীমদ্ভাগবত: প্রথম স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়, ২-৩ )

শ্রীমদ্ভাগবতের শুরুতেই ০১.০১.০৩ শ্লোকে পরমেশ্বরের বাণী বেদকে একটি একটি কল্পবৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়েছে,আর সেই কল্পবৃক্ষের একটি পাকা টসটসে রসালো ফল বলা হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতকে। বর্তমানে আমরা রসালো ফল নিয়েই এতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে কল্পবৃক্ষকেই অস্বীকার করে ফেলছি। ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো বলেই চলেছি-

এযুগে বেদ নিষিদ্ধ!

কিন্তু একথা ভুলেও চিন্তা করছি না যে, অনন্ত বৈদিক জ্ঞানের পরম্পরায় উৎপত্তিলাভ করেছে শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা।

আজ আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্যময় রূপ নয়, বৈরাগ্যমময় রূপ নয়, তাঁর ধর্ম সংস্থাপন রূপ নয়, তাঁর পুরুষোত্তম রূপও নয় ; তাঁর শ্রেষ্ঠতম ঐশ্বরিক মাধুর্য রূপকে, আমাদের মনুষ্য অথবা মনুষ্যেতর পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রতিনিয়ত অপমান করে চলছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে মনুষ্যকৃত প্রেমিক সাজিয়ে আমরা অসংখ্য কাব্য,নাটক, সিনেমা এবং যাত্রাপালা করে চলছি। কিছু মানুষের সৃষ্টির নামে অপসৃষ্টি দেখলে মনে হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝিবা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালারই চেংড়া নায়ক!

তাই বাধ্য হয়ে বলতেই হয়, যেদিন থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাত্রাপালার নায়ক হয়েছে সেদিন থেকেই হিন্দুদের কপাল পুড়েছে। জীবনব্যাপী চরম রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও জগতের অশেষ কল্যাণ চিন্তা করে তিনি সেই সময়ের সকল কল্যাণকামী রাজাদের একত্রিত করেছিলেন। এমনই স্বার্থহীন ছিলেন যে রাজ্য জয় করেও নিজে কখনো ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। হাজার হাজার নিপীড়িত নারীর আর্তধ্বনি ছিলো নরকাসুরের কারাগারে, সেই নারীদের মুক্তি দিয়ে তিনি নারী মুক্তির পথও উন্মোচন করেছিলেন। প্রায় দশবছর বয়সেই তিনি বৃন্দাবন থেকে মথুরায় চলে যান। এরপর আর কখনোই তিনি বৃন্দাবনে আসেননি।

আরো পড়ুন - জন্মাষ্টমী কি ও কেন!

বৃহৎ ভারতবর্ষ এর সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল তিনি। তাই এই অঞ্চলের সংগীত, নৃত্যসহ কলাবিদ্যার প্রায় সকল কিছুই তার জীবনককে অবলম্বন করে রূপায়িত। এমনকি বাংলা ভাষাও বিকশিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীকে অবলম্বন করে। বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস থেকে আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথ সবাই কানহার প্রেমে মাতোয়ারা ছিলো।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা যে খ্রিস্টপূর্ব বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত, এর অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ হলো ভারতের মধ্যপ্রদেশের বেসনগরে হোলিওডোরাস গরুড়স্তম্ভ।

এই স্তম্ভ এবং স্তম্ভলিপিটি হোলিওডোরাস নামক একজন গ্রীক রাষ্ট্রদূত ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছেন আনুমানিক ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। শুঙ্গ বংশের পঞ্চম রাজা কৌৎসীপুত্র ভাগভট্টের রাজত্বকালে গ্রীক রাজা আন্টিয়ালসিডাসের Antialcidas

ভারতে প্রেরিত রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন হোলিওডোরাস। ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত স্তম্ভলিপিটিতে ভগবান বাসুদেবের মাহাত্ম্যের সাথে সাথে হোলিওডোরাস নিজেকে ভগবানের ভক্ত পরম ভাগবত বলে পরিচয় দিয়েছেন।

ভাবতে অবাক লাগে প্রায় ২২০০ বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে, স্তম্ভলিপি খোদিত করেছেন একজন গ্রীক রাষ্ট্রদূত। আমরা কয়জন এ তথ্যটি জানি?

এরকম অসংখ্য সনাতন ধর্ম বিষয়ক পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে আবিস্কারের অপেক্ষায় ; যেগুলি আবিস্কৃত হলে ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় সাথেসাথে বিদেশীদের প্রচারিত এদেশীয় ইতিহাসের সকল মিথ্যাচারই একদিন চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্তী
সহ-অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নবীনতর পূর্বতন