সনাতনধর্মের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস।

সনাতন ধর্মের প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস, history of hinduism



শ্রী বিপ্লব কান্তি নাথহিন্দুধর্ম আজ একাধিক শাখায় বিভক্ত। অতীতে এই ধর্ম ছয়টি দর্শনে                                          বিভক্ত ছিল।বর্তমানে এগুলির মধ্যে কেবল বেদান্ত ও যোগেরই অস্তিত্ব আছে। আধুনিক হিন্দুধর্মের প্রধান বিভাগগুলি হল বৈষ্ণব ধর্ম, শৈব ধর্ম, স্মার্তবাদ ও শাক্তধর্ম। এছাড়াও একাধিক ছোটো বিভাগ বা উপবিভাগ লক্ষিত হয়, যাদের অনেকগুলিই পরস্পরের সঙ্গে অংশত আবৃত। তবে আজকের হিন্দুরা মোটামুটিভাবে পূর্বোক্ত চারটি প্রধান শাখার কোনো না কোনো একটির সদস্য।

২০০৭ সালে অধিকতর জটিল ও সূক্ষ্ম বিবেচনার নিরিখে একাধিক মতের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের দিকটি বিচার করে ম্যাকড্যানিয়েল হিন্দুধর্মের আরো ছয়টি শাখাকে চিহ্নিত করেছেন। এই বিভাগগুলি হল -
* লৌকিক হিন্দুধর্ম : বিভিন্ন স্থানীয় ঐতিহ্য ও লৌকিক দেবদেবীর পূজাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বা সম্প্রদায় স্তরের ধর্মবিশ্বাস যা প্রাগৈতিহাসিক কাল বা অন্ততপক্ষে বেদ রচিত হবার আগে থেকে প্রচলিত।

* বৈদিক হিন্দুধর্ম : এই বিশ্বাসটি এক শ্রেুীর ব্রাহ্মণ (বিশেষত শ্রুতিবাদী) সমাজে আজও প্রচলিত।

* বৈদান্তিক হিন্দুধর্ম : উপনিষদের শিক্ষা অবলম্বনে প্রচারিত। উদাহরণ-অদ্বৈত (স্মার্তবাদ)

* যৌগিক হিন্দুধর্ম : পতঞ্জলি রচিত যোগসূত্র অবলম্বনে প্রচারিত।

* ধার্মিক হিন্দুধর্ম বা প্রাত্যহিক নৈতিকতা : কর্ম ও হিন্দু বিবাহ সংস্কার ইত্যাদি সামাজিক নিয়মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাখা।

* ভক্তিবাদ : বৈষ্ণব ধর্মের অনুরূপ ভক্তি কেন্দ্রিক মতবাদ।

হিন্দুধর্মের ইতিহাস

হিন্দুধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম তবে হিন্দু নামটি আধুনিকালের দেওয়া। এর প্রাচীননাম হল সনাতন ধর্ম। আবার এই ধর্ম বৈদিক ধর্ম নামেও পরিচিত। এই ধর্ম বেদ এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এ ধর্মত্ত্বের মূল কথা হল ঈশ্বরের অস্তিত্বেই সকল কিছুর অস্তিত্ব এবং সকল কিছুর মূলেই স্বয়ং ঈশ্বর। খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০০-২৬০০ অব্দের দিকে যখন কিনা হাপ্পান যুগ ছিল ঠিক সেই সময়ই এ ধর্মের গোড়ার দিক। অনেকের মতে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ। কিন্তুইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে আর্য (বা অৎুধহ) জাতিগোষ্ঠি ইউরোপের মধ্য দিয়ে ইরান হয়ে ভারতে প্রবেশ করে খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের মধ্যে, তারাই ভারতে বেদ চর্চা করতে থাকে এবং তারা সমগ্র ভারতে তা ছড়িয়ে দেয়।
আর্য জাতিগোষ্ঠিরা অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলত। তারা চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল এরা হলঃ ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। এই সম্প্রদায়গুলো তৈরি করার অন্যতম কারণ হল কাজ ভাগ করে নেওয়া অর্থাৎ এক এক সম্প্রদায় এর লোক এক এক ধরনের কাজ করবে। অনেকের মতে হিন্দু শব্দটি আর্যদেরকে আফগানিস্তানের বাসিন্দা বা আফগানেরা দিয়েছে তারা সিন্দু নদের তীরবর্তী সনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিদেরকে হিন্দু বলত, আর এই ভাবেইহিন্দু নামটি এসেছে। এই সনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিরাই বেদ শ্রুতিবদ্ধ করেন অর্থাৎ ধ্যানের মাধ্যমে বেদ আয়ত্ব করেন। বেদ কোন একজন সাধু বা সন্ন্যাসির লব্ধকৃত নয়, বেদ হল বহু সাধু সন্ন্যাসিদের লব্ধকৃত এক মহান শ্রুতিবদ্ধ গ্রন্থ যা প্রথম অবস্থায় সবার মনে মনে ছিল পরে তাকে লিপিবদ্ধ করা হয়।

তখন কার যুগে এই বেদের আধিপত্য ছিল ব্যাপক, অর্থাৎ সমাজের সকল কাজ বেদের মাধ্যমে চলত কারণ বেদে সমাজ চালানো, চিকিৎসা করা, গণনা করা এমন সব উপাদানই আছে। এই কারনে তখনকার সভ্যতাকে বলা হয় বৈদিক সভ্যতা।

এই বৈদিক সভ্যতায় অর্থাৎ ঐ আমলে কোন মূর্তি পূজা করা হত না। সেই সময় হিন্দুদের প্রধান দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি এবং সোম। তারা যজ্ঞের মাধ্যমে পূজিত হত। তখনকার ঈশ্বর আরাধনা হত যজ্ঞ এবং বেদ পাঠের মাধ্যমে। সকল কাজের আগে যজ্ঞ করা ছিল বাঞ্ছনীয়। সে আমলে কোনমূর্তি বা মন্দির ছিল না। ধারনা করা হয়ে থাকে যে খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে রামায়ণ এবং মহাভারত শ্রুতিবদ্ধ হয়। বর্তমানে এই সমস্ত মহান ধর্ম গ্রন্থগুলোর লিখিত রূপ হয়েছে। এই রামায়ণ এবং মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে ধর্ম এবং যুদ্ধের কাহিনী। এছারাও পুরাণ নামে যে ধর্মগ্রন্থগুলো রয়েছে তাতে দেবতাদের এবং অসুরদের যুদ্ধ নিয়ে ঘটনা আছে।

যুগকরণ

জেমস মিল (১৭৭৩-১৮৩৬),তাঁর দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া (১৮১৭) গ্রন্থে, ভারতের ইতিহাসের তিনটি পর্যায়ক্রম করেছেন, যেমন হিন্দু, মুসলিম ও ব্রিটিশ সভ্যতা। এই যুগকরণ, ভ্রান্ত ধারনা বৃদ্ধির জন্য সমালোচিত হয়েছে। আরেকটি যুগকরণ হল "প্রাচীন, ধ্রুপদী, মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক সময়ের" মধ্যে বিভাগ। স্মার্ট এবং মাইকেলস মনে হয় মিল-এর যুগকরণ অনুসরণ করেছেন, যেখানে ফ্লাড এবং মুয়েস "প্রাচীন, ধ্রুপদী, মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক সময়সীমার" অনুসরণ করেছেন।

বিভিন্ন যুগকে "ধ্রুপদী হিন্দুধর্ম" হিসেবে মনোনীত করা হয়:

স্মার্ট ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং ১০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যের সময়কে "প্রাকধ্রুপদ" বলেন। এটা উপনিষদ্ এবং ব্রহ্মতত্ত্ব জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম-এর জন্য গঠনমূলক সময়। স্মার্ট-এর মতে, "ধ্রুপদী যুগ" ১০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ স্থায়ী হয়, এবং ভারতের "ধ্রুপদী হিন্দুধর্ম" প্রস্ফুটিত হওয়া এবং মহাযান-বৌদ্ধধর্ম-এর বিকাশ ও ক্ষয় সমানুপাতিক।
মাইকেলস-এর মতে, ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যের কাল একটি "তপস্বী সংস্কারবাদ" যুগ, যেখানে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং ১১০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যের যুগ "ধ্রুপদী হিন্দুধর্ম"-এর সময়, যেহেতু "বৈদিকধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে একটি সন্ধিক্ষণ" আছে।
মুয়েস এক দীর্ঘ যুগ পরিবর্তনের পার্থক্য করেন, যেমন ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ এবং ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, যা তিনি "ধ্রুপদী যুগ" বলেন। মুয়েস-এর মত অনুযায়ী, হিন্দুধর্মের কিছু মৌলিক ধারণা, যেমন কর্মবাদ, পুনর্জন্মবাদ ও "আত্মউদ্বোধন এবং রূপান্তর", বৈদিকধর্মে যা বিদ্যমান ছিল না, এই সময় বিকশিত হয়।
হিন্দু উৎসব (আক্ষরিক অর্থে: উত্তরণ) প্রতীকী ধর্মানুষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা সুন্দরভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে ধর্মের পথে চালিত করে। হিন্দুধর্মে সারা বছর ধরে অনেক উৎসব রয়েছে। হিন্দু দেওয়ালপঞ্জিকাতে সাধারণত তাদের তারিখ নির্ধারিত থাকে।
হিন্দু উৎসব সাধারণত পুরাণের ঘটনা অবলম্বনে, প্রায়শই ঋতু পরিবর্তন সঙ্গে সঙ্গে একত্রে উদযাপন করা হয়ে থাকে। সাধারণত উৎসবগুলি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ে আথবা ভারতীয় উপমহাদেশেরনির্দিষ্ট অঞ্চলে উদযাপন করা হয়।
কিছু ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হিন্দু উৎসব হল :
হিন্দুধর্ম এমনই একটি মূলধারার ধর্মবিশ্বাস যা একটি সুবিস্তৃত ভৌগোলিক ক্ষেত্রে এক বহুধাবিভক্ত জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে বিকাশলাভ করেছে। এই বিকাশলাভ সম্ভবপর হয়েছে মূলত দুটি পন্থায়: হিন্দুধর্মের পুরনো রীতিনীতির নবীকরণ এবং বহিরাগত রীতিনীতি ও সংস্কৃতি থেকে আত্মীকরণ। এর ফলে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক বিরাট বৈচিত্র্যময় সমাবেশ গড়ে উঠেছে। এই সমাবেশে যেমন স্থান পেয়েছে অসংখ্য ছোটো ছোটো আদিম ধর্মমত, তেমনই স্থান পেয়েছে সমগ্র উপমহাদেশে লক্ষাধিক মতাবলম্বী সমন্বিত প্রধান ধর্মসম্প্রদায়গুলিও। বৌদ্ধধর্ম বা জৈনধর্মের থেকে পৃথক ধর্মবিশ্বাসরূপে হিন্দুধর্মের পরিচিতিও তাই এই মতাবলম্বীদের অনুমোদনসাপেক্ষ বিষয়।
হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের প্রধান উপাদানগুলি হল : ধর্ম (নৈতিকতা/কর্তব্য), সংসার (জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্মের চক্র), কর্ম (ক্রিয়া ও তার প্রতিক্রিয়া), মোক্ষ (সংসার থেকে মুক্তি) ও বিভিন্ন যোগ (ধর্মানুশীলনের পন্থা)।

হিন্দুধর্মে ঈশ্বর

একেশ্বরবাদ, বহুদেববাদ, সর্বেশ্বরময়বাদ, অদ্বৈতবাদ, নাস্তিক্যবাদ সকল প্রকার বিশ্বাসের সমাহার দেখা যায় হিন্দুধর্মে। তাই হিন্দুধর্মে ঈশ্বরধারণাটি অত্যন্ত জটিল। এই ধারণা মূলত নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য অথবা দর্শনের উপর নির্ভরশীল। কখনও কখনও হিন্দুধর্মকে হেনোথেইস্টিক ধর্ম (অর্থাৎ, বহু দেবতা অস্তিত্ব স্বীকার করার পাশাপাশি এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মব্যবস্থা) বলে উল্লেখ করা হয়। তবে এধরনের বর্গীকরণ অতিসরলীকরণের নামান্তর।
হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে মানুষের আত্মা শাশ্বত। অদ্বৈত বেদান্তের ন্যায় অদ্বৈতবাদী/সর্বেশ্বরময়বাদী দর্শন অনুসারে, আত্মা সর্বশেষে পরমাত্মা ব্রহ্মেবিলীন হয়। এই কারণেই এই দর্শন অদ্বৈত দর্শন নামে পরিচিত। অদ্বৈত দর্শনের মতে, জীবনের উদ্দেশ্য হল আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা অনুভব করা। উপনিষদে বলা হয়েছে, মানুষের পরমসত্ত্বা আত্মাকে যিনি ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন রূপে অনুভব করতে সক্ষম হন, তিনিই মোক্ষ বা মহামুক্তি লাভ করেন।
দ্বৈত ও ভক্তিবাদী দর্শনে ব্রহ্মের উপর ব্যক্তিত্ব আরোপিত হয়েছে। এই মতানুসারে সম্প্রদায়বিশেষে তাঁকে বিষ্ণু, ব্রহ্মা, শিব বা শক্তিরূপে পূজা করা হয়।আত্মা এখানে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল এবং মোক্ষ নির্ভরশীল ঈশ্বরের প্রতি প্রেম অথবা ঈশ্বরের অনুগ্রহের উপর। পরমসত্ত্বা রূপে ঈশ্বর হিন্দুধর্মেঈশ্বর (প্রভু ), ভগবান (পবিত্র ব্যক্তি) বা পরমেশ্বর (সর্বোচ্চ প্রভু) নামে আখ্যাত। অবশ্য ঈশ্বর শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মীমাংসাবাদীরা ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন; আবার অদ্বৈতবাদীরা ব্রহ্ম ও ঈশ্বরকে অভিন্ন মনে করেন। অধিকাংশ বৈষ্ণব ঐতিহ্যে তিনি বিষ্ণু। বৈষ্ণব শাস্ত্রগুলি তাঁকে কৃষ্ণ বা কখনও কখনও স্বয়ং ভগবানের রূপে দর্শিয়েছে। আবার সাংখ্য দর্শন নাস্তিক্যবাদী মনোভাবাপন্ন।
দেবতা ও অবতারগণ
হিন্দুধর্মে দৈব ব্যক্তিত্বদের দেব (স্ত্রীলিঙ্গে দেবী) নামে অভিহিত করা হয়। বাংলায় দেবতা শব্দটি দেব শব্দের সমার্থক শব্দরূপে বহুল প্রচলিত। শব্দটির আক্ষরিক দৈব সত্ত্বা। আবার ইংরেজি ভাষায় শব্দটি গড শব্দের সমার্থক। হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেন হিন্দু দেবগণ। চিত্রকলা ও স্থাপত্যে মূর্তির আকারে এবং বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে, বিশেষত ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণে নানান উপাখ্যানে তাঁদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈশ্বরেরথেকে এঁরা পৃথক। অনেক হিন্দুই তাঁদের ইষ্টদেবতার রূপে ঈশ্বরকে পূজা করে থাকেন। ইষ্টদেবতার নির্বাচন ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক বা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে হয়ে থাকে।
হিন্দু মহাকাব্যে ও পুরাণের একাধিক কাহিনিতে বর্ণিত হয়েছে, কেমন করে দেবগণ মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়ে সমাজে ধর্ম সুরক্ষিত করেছেন এবং মানুষকে মোক্ষপথে চালিত করেছেন। এই প্রকারের অবতীর্ণ রূপ অবতার নামে পরিচিত। হিন্দুধর্মে বিষ্ণুর অবতারগণ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। রামায়ণের নায়করাম ও মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র কৃষ্ণ বিষ্ণুরই অবতার রূপে চিত্রিত।
কর্ম ও সংসার
কর্মের আক্ষরিক অর্থ হল কার্য, ক্রিয়া অথবা করণ এবং বলা যেতে পারে এটি হল "কারণ এবং করণের (কার্যের) নৈতিক ধর্ম"। উপনিষদ মতে একজনমানুষ (অর্থাৎ জীবত্মা) সংস্কার (লব্ধ জ্ঞান) অর্জন করে তার শারিরীক ও মানসিক কর্মের মধ্যে দিয়ে। মানুষের মৃত্যুর পর সমস্ত সংস্কারগুলি যথাযথ ভাবে তার লিঙ্গ-শরীরে (যে শরীর রক্ত-মাংসের শরীর থেকে সুক্ষ অথচ আত্মার থেকে স্থূল) বিদ্যমান থাকে এবং পরজন্মে তার সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ তৈরী করে। সুতরাং, একটি সর্বজনীন, নিরপেক্ষ, এবং অব্যর্থ কর্মের ধারণা মানুষের পুনর্জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, এবং পরিবার সম্পর্কিতধারণার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও ভাগ্য প্রভৃতি ধারণাগুলিকে কর্ম একত্রে সংযুক্ত করেছে।

কার্য, কারণ, জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বৃত্তাকার পরম্পরাই হল সংসার। দেহধারণ এবং কর্মফল ধারণা সম্পর্কে হিন্দুধর্মে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ চিন্তার পকাশ দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগ্বতগীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে :
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।

অর্থাৎ: মানুষ যেমন জীর্ণ-শীর্ণ পুরোনো বস্ত্রগুলি ত্যাগ করে অন্য নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ জীবাত্মা পুরোনো শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীরগ্রহণ করে।
যেখানে সংসার ক্ষণিকের আনন্দ দেয়, যা মানুষকে আরেকটি বিনাশশীল শরীর পরিগ্রহ করতে উৎসাহী করে। সেখানে মোক্ষ এই সংসারের গ-ী থেকে মুক্ত হয়ে চির আনন্দ ও শান্তির বিশ্বাস প্রদান করে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস যে অনেকগুলি জন্মান্তরের পর অবশেষে জীবাত্মা মহাজাগতিক আত্মায় (ব্রহ্ম/পরমাত্মা) মিলিত হতে ব্যাকুল হয়।

জীবনের চরম লক্ষ্যকে (চরম লক্ষ্য বলতে এখানে মোক্ষ অথবা নির্বাণ অথবা সমাধি) বিভিন্ন ভাবে বোঝানো হয়েছে : যেমন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতার বোধ; যেমন ঈশ্বরের সঙ্গে অবিছ্যেদ্য সম্পর্কের বোধ; যেমন সমস্ত বস্তুর সম্পর্কে অদ্বৈত বোধ; যেমন আত্ম বিষয়ক বিশুদ্ধ নিস্বার্থতা ও জ্ঞান; যেমন নিখুঁত মানসিক শান্তিলাভ; এবং যেমন পার্থিব বাসনার থেকে অনাসক্তি বোধ। এই ধরনের উপলব্ধি মানুষকে সংসার এবং পুনর্জন্মের বন্ধন থেকে মুক্ত করে। আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস থাকার ফলে, মৃত্যুকে পরমাত্মার তুলনায় নেহাত্ই তুচ্ছ মনে হয়। অত:পর, একজন ব্যক্তি যার কোন ইচ্ছা বা উচ্চাকাক্সক্ষা বাকি নেই এবং জীবনের কোন দায়িত্বই বাকি নেই অথবা একটিও রিপু দ্বারা আক্রান্ত নয়, সে প্রায়োপবেশন (যার আক্ষরিক অর্থ হল মৃত্যু কামনায় উপবাসের মাধ্যমে দেহত্যাগ) দ্বারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে।

মোক্ষের ধারণা সম্বলিত বিষয়গুলি বিভিন্ন হিন্দু দার্শনিক গোষ্ঠীগুলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন। উদাহরণ স্বরূপ, যেমন অদ্বৈত বেদান্তবাদীরা বিশ্বাস করে যে মোক্ষ লাভের পর একটি জীবাত্মা নিজেকে পরমব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কিছু মনে করতে পারেনা। আবার দ্বৈতবাদীরা নিজেদের ব্রহ্মের অংশ বলে মনে করে, এবং মোক্ষ লাভের পর স্বর্গালোকে ঈশ্বরের সঙ্গে অনান্তকাল বাস করবে বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং, এক কথায় বলা যায় যে যেখানে দ্বৈতবাদীরা চায় "চিনিখেতে", সেখানে অদ্বৈতবাদীরা চায় "চিনি হতে"।

মূল নিবন্ধগুলি : শ্রুতি, স্মৃতি এবং হিন্দু ধর্মগ্রন্থ তালিকা
হিন্দুধর্ম "বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা আবিষ্কৃত আধ্যাত্মিক আইন সঞ্চিত কোষাগার"-এর উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। লিপিবদ্ধ করার আগে বহু শতাব্দী ধরে, ধর্মগ্রন্থগুলি মুখস্থ বিদ্যার সাহায্যে পদ্য আকারে মুখে মুখে প্রেরিত হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে, ঋষিগণ ধর্মশাস্ত্রগুলিকে পরিবর্ধিত এবং তার শিক্ষাসমূহের পরিমার্জন করেছেন। বৈদিক পরবর্তী এবং বর্তমান হিন্দুদের বিশ্বাস, অধিকাংশ হিন্দু ধর্মগ্রন্থের সাধারণতঃ আক্ষরিক ব্যাখ্যা করা হয় না। অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় সেগুলির সঙ্গে সংযুক্ত নৈতিকতা এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত রূপক অলংকারযুক্ত অর্থবাদে। অধিকাংশ পবিত্র গ্রন্থগুলি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। ধর্মগ্রন্থগুলি শ্রুতি ও স্মৃতি এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত।

শ্রুতি

ঋগবেদ হল এক প্রাচীনতম ধর্মীয় গ্রন্থ। এইটি হলদেবনাগরী লিপিতে লিখিত হস্তলিখিত ঋগবেদ। শ্রুতি (আক্ষরিক অর্থে: যা শুনতে হয় অর্থাৎ শ্রোতব্য) বলতে প্রাথমিকভাবে বেদকে বোঝায়, যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থের প্রাচীনতম সাক্ষ্যপ্রমাণ। যদিও বেশিরভাগ হিন্দু বেদকে শাশ্বত সত্য প্রকাশ হিসাবে এবং প্রাচীন মুণিদের দ্বারা শ্রুত বলে সম্মান করে, কিছু ভক্ত কোনও দেবতা বা ব্যক্তি বেদ সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত নয় বলে মনে করে। তারা এটিকে আধ্যাত্মিক জগতের আইন হিসাবে মনে করে, যা ঋষিদের দ্বারা উদ্ভূত না হওয়া সত্ত্বেও এখনও বিদ্যমান। হিন্দুদের বিশ্বাস, যেহেতু বেদের আধ্যাত্মিক সত্য শাশ্বত, সেহেতু সেগুলিকে অবিরত নতুন উপায়ে প্রকাশ করা সম্ভব।

বেদ চার ভাগে বিভক্ত (ঋক, সাম, যজু এবং অথর্ব)। ঋগ্বেদ হল সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বেদ। প্রত্যেক বেদ আবার চার ভাগে বিভক্ত: প্রাথমিক ভাগ, মূল বেদ, সংহিতা বর্তমান, যাতে পবিত্র মন্ত্র রয়েছে। অন্য তিনটি অংশ সাধারণত গদ্য আকারে গঠিত ত্রিস্তর আলোচনা সমাহার এবং সংহিতা থেকে বয়সে সামান্য পরবর্তীকালের বলে বিশ্বাস করা হয়। এগুলি হল: ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ্। প্রথম দুটি অংশকে পরবর্তীকালে কর্মকা- (আনুষ্ঠানিক অংশ) বলা হয়েছে, যেখানে শেষের দুইটি অংশ নিয়ে জ্ঞানকান্ড (শিক্ষামূলক অংশ) গঠিত। যেখানে বেদ ধর্মানুষ্ঠানের উপর কেন্দ্রীভূত, সেখানে উপনিষদ আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও দার্শনিক শিক্ষার উপর অধিশ্রিত, এবং ব্রহ্ম ও জন্মান্তর বিষয়ে আলোচিত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি সুপরিচিত শ্লোক হল:
অসতো মা সদ্গময় ।
তমসো মা জ্যোতির্গময় ।
মৃত্যোর্ মা অমৃতম্ গময় ।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

বঙ্গানুবাদ:
অবাস্তব থেকে বাস্তবে আমাদের পথপ্রদর্শন কর ।
অন্ধকার থেকে আলোকে আমাদের পথপ্রদর্শন কর ।
মৃত্যু থেকে অমরত্বে আমাদের পথপ্রদর্শন কর ।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

শ্রীমদ্ভগব˜্গীতা, একটি ১৯ শতকের পা-ুলিপি
নারদীয় পুরাণ নিসর্গ বলবিজ্ঞান বর্ণনা করে। এখানে দেখানো হয়েছে শেষনাগের উপর বিষ্ণু তাঁর সহধর্মিনী লক্ষ্মীর সঙ্গে যোগনিদ্রায় মগ্ন। এছাড়ানারদ এবং ব্রহ্মা-ও অঙ্কিত রয়েছে।
শ্রুতি ছাড়া অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিকে সামগ্রিকভাবে স্মৃতি (যে বিষয় স্মরণ করা হইয়াছে) বলা হয়। স্মৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মহাকাব্যগুলি, যা মহাভারত এবং রামায়ণ ইত্যাদিতে নিহিত রয়েছে।ভগবদ্গীতা মহাভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং হিন্দুধর্মের একটি সবচেয়ে জনপ্রিয় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। এতে একটি মহান যুদ্ধ প্রাক্কালে রাজকুমার অর্জুনকে বলা, একজন বিষ্ণু অবতার, শ্রীকৃষ্ণ থেকে প্রাপ্ত দার্শনিক শিক্ষা রয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণ দ্বারা কথিত, ভগবদ্গীতা, বেদের সারাংশ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে কখনও কখনও গীতোপনিষদ্ বলে উল্লেখিত, শ্রীমদ্ভগব˜্গীতা, ঔপনিষদ্কি তত্ত্বের কারণে, বিভাগ হিসাবে, প্রায় শ্রুতির মধ্যেই ধরা হয়। স্মৃতির অন্তর্গত পুরাণ, যা বিভিন্ন অবিস্মরণীয় আখ্যায়িকা দ্বারা হিন্দু ধারণা চিত্রিত করে। এর অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য গ্রন্থগুলি হলদেবীমাহাত্ম্যম্, তন্ত্র, যোগসুত্র, তিরুমন্ত্রম্, শিবসূত্র এবং হিন্দু আগম। মনুস্মৃতি হল একটি প্রচলিত নীতিগ্রন্থ, যা সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপর নিবন্ধিত সামাজিক নিয়মাবলী, যা পরে ভারতীয় বর্ণাশ্রমতৈরি করতে সমাজকে সাহায্য করেছে।
শ্রীমদ্ভগব˜্গীতা থেকে কর্মযোগ সম্বন্ধে একটি ধারণা বর্ণনার একটি সুপরিচিত শ্লোক ব্যাখ্যা করা হয় নিম্নরূপে-

কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই ।
কর্মফল যেন তোমার কর্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয়,
কর্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয় ।। (অ: ২। শ্লোক ৪৭)

লেখাটি পাঠিয়েছে - শ্রী বিপ্লব কান্তি নাথ
নবীনতর পূর্বতন