সনাতন ধর্ম মতে শক্তিবাদ এবং বৈদিক যুগে শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল। ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত ও রাত্রিসূক্ত এবং সামবেদের রাত্রিসূক্ত হইতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক যুগে শক্তিবাদ বর্ধিত হইয়াছিল। অষ্টমন্ত্রাত্মক দেবীসূক্তের ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্। বাক্ ব্রহ্মশক্তিকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করিয়া বলিয়াছিলেন, “আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাদেবী ও বিশ্বেশ্বরী।” সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্রে ‘ভদ্রকালী’ নামটি আছে। হিরণ্য-কেশী গৃহ্যসূত্রে ভবানী দেবীকে যজ্ঞাহুতি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। উক্ত আরণ্যকের নারায়ণ নারায়ণী নামে উপনিষদে আছে। শক্তি বেদেমূল তাই শক্তির প্রথম চরিত্র ঋগ্বেদস্বরূপা, মধ্যম চরিত্র যজুর্বেদস্বরূপা ও উত্তর চরিত্র সামবেদস্বরূপা। চরিত্রত্রয়ের ছন্দ যথাক্রমে গায়েত্রী, উষ্ণিক্ ও অনুষ্টুপ্। ঋগ্বেদের মতে উক্ত ছন্দত্রয়-দ্বারা মন্ত্রপাঠে যথাক্রমে ব্রহ্মতেজ-লাভ, আয়ু-বৃদ্ধি ও পরমানন্দ প্রপ্তি হয়। তাই বৈদিক ধর্ম পবিত্র বেদের জ্ঞান অর্জন করা দরকার। এখানে শক্তি, রমণীয় পত্নী ও রতিশক্তি, ঐশ্বর্য ও দানশক্তি এসব অল্প তপস্যার ফল নয়। অবিচার, অনাচার ও দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে দু’টি শক্তি, একটি সত্যাশ্রয় জ্ঞান এবং অপরটি ন্যায়ধর্ম। সত্য ও ন্যায়ের সন্ধান লাভ করতে হলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে সে পথ শিক্ষার, যার মাধ্যমে আত্মোৎকর্ষ লাভ করা যায়।
ঈশ্বর ও ব্রহ্মঃ
ধর্মদর্শন ও সাধনাঃ
"ওম্।। ন ত্বাবাং অন্যো দিব্যো ন পার্থিবো ন জাতো ন জনিষ্যতে অশ্বায়ন্তো মঘবন্নিন্দ্র বাজিনো গব্যন্তস্তা হবামহে।।" (সাম উত্তরাঃ ৬৮১)
অর্থ অনুবাদঃ— হে পরমেশ্বর! (ত্বাবান) অাপনার সমক্ষ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে (অন্যঃ) অার অন্য কেহই (দিব্যঃ ন) দিব্য গুন কর্ম স্বভাব যুক্ত নেই (ন পার্থিবঃ) এবং অন্য কোন পার্থিব শক্তি, (নুজাতঃ) না তো হয়েছে, (ন জনিষ্যতে) অার না তো ভবিষ্যতে হবে। হে (মঘবন) ঐশ্বর্যশালী পরমেশ্বর! (বাজিনঃ) অাপনার বল শক্তি পরাক্রম দ্বারা (অশ্বায়ন্তঃ) মনোবলকে তীব্র শক্তিশালী করবার জন্য (গব্যন্তঃ) অভ্যান্তরীন বল বীর্য পরাক্রমকে অাত্ম জ্ঞানের সঙ্গে (ত্বা) কেবল মাত্র অাপনাকেই (হবামহে) প্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা উপসনাদি করিতেছি।
শক্তি মানে কি?
শক্তি— (বিশেষ্য পদ) বল, সামর্থ্য, ক্ষমতা, (প্রাণশক্তি, শরীরের শক্তি), স্ত্রী দেবতা, দুর্গা।
তটস্থা শক্তি দর্শনে ভগবানের জীব-সৃষ্টিকারী শক্তি, জীব-শক্তি। শক্তি (শক্ল শক্তৌ) এই ধাতু হতে 'শক্তি' শব্দ সিদ্ধ হয়।
'য়ঃ সর্বং জগৎ কর্ত্তুং শক্লোতি স শক্তিঃ'
অর্থাৎ যিনি সকল জগতের রচনায় সমর্থ, সেই পরমেশ্বরের নাম 'শক্তি'। অর্থাৎ ঈশ্বরেরই একটা নাম শক্তি। শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি কেবল একরূপ থেকে অপর এক বা একাধিক।রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়।
এখানে ঈশ্বর নিরাকার পরমাত্মা পরমব্রহ্ম, তিনি মহা শক্তি, তিনি প্রকৃতির শক্তি। মূলত শক্তিই হলেন ঈশ্বর।
ঈশ্বরকে জীবাত্মা বলা হয় কেন?
ঈশ্বর যখন নিজেই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন, তখন তাকে জীবাত্মা বলা হয়।
ঈশ্বর
যঃ প্রাণতো নিনিষতো মহিত্বৈক ইদ্রাজা জগতো বভূব।
য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুষ্পদঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।।
(যজুর্বেদ, ২৩/৩)
অনুবাদঃ— নিজের মহিমাবলে যিনি চেতন ও জড় জগতের রাজা, যিনি দ্বিপদ ও চতুষ্পদ প্রাণীর উপর শাসন করিতেছেন, সেই আনন্দ স্বরুপ পরমাত্মাকে আমরা মনের দ্বারা উপাসনা করি।
শক্তির উপাসনা না থাকলে জগতে ন্যায়, ধর্ম কিছুই থাকে না। এমন কি সংসারের কথা ছেড়ে দিলে শক্তিহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। উপনিষদে তাই আমাদের বৈদিক ঋষিগণ বলেছেন—
" নায়মাত্মা বলহীনের লভ্যঃ"।
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন—
"ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ"।।
এখানেই এই শক্তি কেবল শরীরের নয়, মানসিক শক্তি, অর্থের শক্তি, বিদ্যার শক্তি, জনশক্তি-পৃথিবীর সর্ব বস্তু, এমন কি জড়ের অন্তরালে যে মহাশক্তি সুপ্ত হয়ে আছে। সেই আদিশক্তি, সেই মূলশক্তি। মানুষের মনে যদি দুঃখীর ক্ষুধার দুঃখ দূর করার ইচ্চা হয়, অর্থশক্তি না থাকলে তা পারে না। যদি প্রবলের অত্যাচার থেকে দূর্বলকে বাঁচাতে হয় তবে শারীরিক শক্তি না থাকলে তা সম্ভব হয় না। যদি কঠোর সাধনার শক্তি না থাকে তবে আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। কাজেই জীবনকে সার্থক করে তুলতে হলে সর্বপ্রকার শক্তি অর্জন মানুষকে অবশ্যই করতে হবে।
তীক্ষ্ণীয়াংসঃ পরশোরগ্নেস্তীক্ষ্ণ তরা উত।
ইন্দ্রস্য বজ্রাত্তীক্ষ্ণীয়াংসো যেষামস্মি পুরোহিতঃ।।
(অথর্ববেদ, ৩/১৯/৪)
অনুবাদঃ— আমি যাঁহাদের অগ্রণী বা পুরোহিত হইয়াছি তাঁহাদের অস্ত্র শস্ত্র কুঠার হইতেও অধিক, অগ্নি হইতেও অধিক এবং পরমাত্মার বৈদ্যুতিক শক্তি হইতে অধিক তীক্ষ্ণ হউক।
পবিত্র বেদে আছে,
দৃষ্টি শক্তি
চক্ষুঃ শ্রোত্রং যশো অস্মাসু ধেহ্যন্নম্।
রেতো লোহিত মুদরম্।।
(অথর্ববেদ, ১১/৭/২৬)
অনুবাদঃ— হে পরমাত্মন্! আমাদের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি, যশ, অন্ন, বীর্য্য, রক্ত ও পাচন শক্তির বৃদ্ধি কর।
পবিত্র বেদে আছে,
বীর্য্য প্রার্থনা বা শক্তি প্রার্থনা
ওঁ তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহি।
ওঁ বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি।
ওঁ বলমসি বলং ময়ি ধেহি।
ওঁ ওজোহসি ওজো ময়ি ধেহি।
ওঁ মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি।
ওঁ সহোহসি সহো ময়ি ধেহি।
(যজুর্বেদ, ১৯/৯)
অনুবাদঃ— হে ভগবান, তুমি তেজঃস্বরুপ, অামাকে তেজ দান কর। তুমি বীর্য্য স্বরুপ, অামাকে বীর্যবান কর। তুমি শক্তির বা বলের মূর্ত্ত বিগ্রহস্বরুপ, অামাকে বল বা শক্তি দান কর। তুমি অফুরন্ত ওজঃ স্বরুপ (জীবনীশক্তি) অামাকে ওজস্বী কর, তুমি অন্যায়ের দণ্ডদাতা ক্রোধস্বরুপ, অামাকে অন্যায়ের প্রতিরোধ শক্তি দান কর। তুমি সহ্যশক্তির ঘনীভুত মূর্তিস্বরুপ, অামাকে সহিষ্ণুতা দান কর।
বাঙ্ম আসন্নসোঃ প্রণশ্চক্ষুরক্ষ্নোঃ শ্রোত্রং কর্ণয়োঃ।
অপলিতাঃ কেশা অশোনা দম্ভা বহু বাহ্বোর্বলম্।।
ঊর্ব্বোরোজো জঙ্ঘয়োর্জবঃ পাদয়োঃ।
প্রতিষ্ঠা অরিষ্টানি মে সর্ব্বাত্মা নিভৃষ্টঃ।
তনুস্তন্বা মে সহে দতঃ সর্বমায়ু রশীয়।
স্যোনং মে সীদ পুরুঃ পৃণস্ব পবমানঃ স্বর্গে।।
(অথর্ববেদ, ১৯/৬০/১-২, ১৯/৬০/২,)
অনুবাদঃ— আমার বাকশক্তি প্রবল থাকুক, নাসিকায় প্রাণশক্তি, চক্ষুতে দৃষ্টিশক্তি অটুট থাকুক। আমার কেশ যেন পলিত না হয়, দন্ত যেন মলিন না হয়, বাহুতে বল, উরুতে ওজঃ শক্তি, জংঘায় বেগ, পদে দৃঢ়তা থাকুক। আমার সব অবয়ব হৃষ্ট পুষ্ট হউক, আত্মা উৎসাহ পূর্ণ হউক। শরীর উৎকৃষ্ট অবস্থায় থাকুক। আমি প্রবল শত্রুর অত্যাচারে যেন আভিভূত না হই। আমি পূর্ণ দীর্ঘ আয়ু যেন লাভ করি, সুখ লাভ যেন হয়, পূর্ণতা যেন প্রাপ্ত হই। আমি পবিত্র হইয়া যেন আনন্দ ভোগ করি।
এখানে ব্রহ্মশক্তি মূলত কি?
ব্রহ্ম অনির্বচনীয় শক্তি পরমাত্মা। যে ব্রহ্মের ওপর নির্ভরশীল। তিনি সেই ব্রহ্মশক্তি। ব্রহ্মের ওপর আধারিত যে সেই ব্রহ্মশক্তি। মায়া আরেকটি বস্তু কিন্তু তার পৃথক সত্তা নেই, মায়াই সবকিছু করছে। জগৎটাকেই ভ্রম বলা হচ্ছে। যেমন— শক্তি ব্রহ্ম ছাড়া নেই, ব্রহ্ম শক্তি ছাড়া নেই। তাই আমরা বলি ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ অর্থাৎ তাঁরা ভিন্ন নন। জগৎটা সত্য, ব্রহ্ম রূপে সত্য। সত্যে সত্য প্রতিষ্ঠা, তাই বলা হয়— ব্রহ্ম সত্য, জগৎ সত্য। যাঁকে মা বলছি তিনিই দেবীঈশ্বর, যাঁকে দেবীঈশ্বর বলছি তিনিই মা। কিছু কিছু ভেদ থাকলেও সত্তা একই।
চিন্তারশক্তি মূলত কি?
চিন্তারশক্তি হইতেই সর্বাপেক্ষা বেশি শক্তি পাওয়া যায়। বস্তু যত সূক্ষ্ম, ইহার শক্তিও ততই বেশি। চিন্তার নীরব শক্তি দূরের মানুষকেও প্রভাবিত করে, কারণ মন এক, আবার বহু। জগৎ যেন একটি মাকড়সার জাল, মনগুলি যেন মাকড়সা। এই জগৎ সর্বব্যাপী এক অখণ্ড সত্তারই প্রকার। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্য দিয়া দৃষ্ট সেই সত্তা এই জগৎ ইহাই মায়া।
পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়
ওঁ ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নি-মাহু রথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি, অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।
(ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬)
অনুবাদঃ— সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁহাকে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করিয়া থাকেন।
ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।
(অথর্ববেদ, ১৩/৪/২)
অনুবাদঃ— পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলিয়া অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলিয়া জানেন তিনিই তাঁহাকে প্রাপ্ত হন।
এখানে ঈশ্বর নিরাকার হোক বা সাকার হোক সবাইকে সত্যিকারের গায়ত্রী মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে এবং শক্তির উপাসনা করতে হবে। যা বৈদিক মতে ছিল তা ভবিষ্যতেও করতে হবে।
জয় শ্রীকৃষ্ণ
জয় মাদূর্গা
হর হর মহাদেব
SVS
(সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ)