অধুনা এমন কিছু গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে যারা দিন-রাত এই বলে গলা ফাটায় যে হিন্দুদের মধ্যে জাত-পাত উচু-নিচুতা ইত্যাদি বেশি। সেখানে মানুষের কোন সুষ্ঠ অধিকার নেই আমরা সাম্যের কথা বলি এই লেবাস দিয়ে অনেক মুক্তচিন্তার হিন্দুদেরও তাদের দলে যুক্ত করছে।
কিন্তু যেসব মুক্তচিন্তার ভাবধারী হিন্দু ওদের মন গলানো রসহীন কথায় মজে গিয়ে ওদের দলে ভীড় করছে তারা কি কোনদিন তাদের প্রধান পবিত্র বেদের সাম্যতার কথা পড়েছে? পুরাণের বিভিন্ন কথায় জাত-পাতের বিষয়ে কথা থাকলেও বেদ এই বিষয়ে বড় উদার।
হিন্দুদের প্রধান প্রমাণ্য গ্রন্থ হচ্ছে বেদ তাই পুরাণের কোন কথা যদি বেদবিরুদ্ধ হয় তবে তা নির্ধিদায় ত্যাগ করা যায়। চলুন পবিত্র বেদের দৃষ্টিতে ধর্ম ও মানবতা সম্পর্কে জানে আসি।
বেদের সাম্যতার মন্ত্র
সমানী প্রপা সহ বোরন্নভাগঃ সমানে যোক্তো
সহ বো যুনজমি।
সমঞ্চোহগ্নিং যপর্যতারা নাভি মিবাভিতঃ।।
(অথর্ববেদ, ৩/৩০/৬)
অনুবাদঃ— হে মনুষ্যগণ তোমাদের ভোজন ও আহার হোক একসাথে, একপাত্রে, তোমাদের সকলকে এক পবিত্র বন্ধনে যুক্ত করেছি, তোমরা সকলে এক হয়ে পরমাত্মার উপাসনা (যজ্ঞাদি, ধ্যান) কর ঠিক যেমন করে রথচক্রের চারদিকে অর থাকে।
এই সনাতন ধর্মই একমাত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উন্নত জাতিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এইজন্যই প্রত্যেকের সত্য ও ঈশ্বরের পথে প্রগতিশীল সমৃদ্ধ জীবন ও নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলার স্বপ্নের দেখা আমাদের কাছে কখনোই দুরাশা হতে পারে না।
পরমেশ্বর সব মনুষ্যের প্রতি উপদেশ দিয়েছেন সকলেরই বেদাধিকার আছে তাই যর্জুবেদে বলা হয়েছে—
ওঁ যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানি জনেভ্যঃ।
বহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্য্যায় চ স্বায় চারণায়।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ,
ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।
(যজুর্বেদ, ২৬/২)
অনুবাদঃ— হে মনুষ্যগণ আমি যেরূপে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, স্ত্রীলোক ও সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মনুষ্যকেই যেমন আমি এই মঙ্গল দায়িনী বেদবানীর উপদেশ দান করিয়াছি, তোমরাও সেইরুপ কর। যেমন বেদবানীর উপদেশ করিয়া আমি বিদ্ধানদের প্রিয় হইয়াছি তোমরাও সেইরূপ হও। দানের জন্য আমি এই সংসারে দানশীল পুরুষদের যেমন প্রিয় হইয়াছি তোমরাও সেইরূপ হও। আমার ইচ্ছা বেদ বিদ্যার প্রচার বৃদ্ধি হউক। আমার মধ্যে যেমন সব্ববিদ্যাহেতু সুখ রহিয়াছে তোমরাও সেইরূপ বিদ্যা গ্রহন ও প্রচার দ্বারা মোক্ষ সুখ লাভ কর।
সনাতন ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম। সনাতনধর্ম অর্থাৎ জাগতিক কল্যাণ হয় বা মোক্ষ সুখ লাভ হয়। অযথা ধর্মে নামে অর্ধম করা কিন্তু আপদ ধর্ম নয়, সনাতন ধর্মই ধার্মিককে রক্ষা করে।
বৈশিষিক দর্শনে বলা হয়েছে,
যতোহভ্যুদয়-নিঃশ্রেয়সিদ্ধি সঃ ধর্মঃ
অর্থাৎ— যা থেকে অভ্যুদয়, জাগতিক কল্যাণ এবং নিঃশেয়স্ বা মোক্ষ লাভ হয় সেটিই ধর্ম।
পবিত্র বেদ ঈশ্বর হইতে সৃষ্টি। এখানে ঋষি সুস্পষ্টভাবে বলিতেছেন যে, হে মনুষ্যগণ আমি যেরূপে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, স্ত্রীলোক এবং অন্যান্য সমস্ত জনগণের জন্যই এই পবিত্র বেদবাণী দান করেছি সুতরাং বেদমন্ত্র উচ্চারণে করা তোমাদের সকলেরই অধিকার অাছে। ইহাতে কোনরুপ সন্দেহের অবকাশ নাই তাই বৈদিক যুগের মনুষ্যগণের মতোই তোমরা সকলেই বেদাশ্রয় হয়ে পবিত্র হও। সকলেই বেদাধ্যয়ন কর। সকলেই বেদানুশীলন করে সনাতন ধর্মকে রক্ষা কর।
ধর্ম এব হতো হন্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিত।
(মহাভারত বনপর্ব, ৩১২/১২৮)
অনুবাদঃ— ধর্মকে যদি তুমি রক্ষা করো, তবে ধর্মই তোমাকে সকল দিক থেকে রক্ষা করবে; পক্ষান্তরে যদি তুমি ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাও, তবে ধর্মই তোমাকে নির্মম ভাবে বিনাশ করবে। তাই সর্বদা ধর্মের আশ্রয়ে থাকো।
ধর্ম নষ্ট হলে ধর্মাশ্রয়ীরও বিনাশ হয়ে থাকে, সুতরাং কখনও ধর্ম নষ্ট করতে নেই।
সত্যাৎ ন প্রমদিতব্যম্।
ধর্মাৎ ন প্রমদিতব্যম্।
কুশলাৎ ন প্রমদিতব্যম্।
(কৃষ্ণযজুর্বেদীয় বৈদিক সমাবর্তন ভাষণ)
অনুবাদঃ— সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না ধর্ম থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না এবং কল্যাণকর কাজ থেকে কখনই বিচ্যুত হবে না।
পবিত্র বেদ বৈদিক নির্দেশ দিয়েছেন এই সনাতন ধর্মকে প্রচার কর।
ধর্মাদর্থঃ প্রভবতি ধর্মাৎ প্রভবতর সুখম্।
ধর্মেণ লভতে সর্ব্য ধর্মসারমিদং জগৎ।।
(অরণকাণ্ড, ৯/৩০)
অনুবাদঃ— ধর্ম হতেই অর্থ এবং প্রভাব আসে, ধর্ম থেকেই সুখ উৎপন্ন হয়। ধর্মের দ্বারাই জগতে সকল অভীষ্ট বস্তুর লাভ হয়; সুতরাং এ জগতে ধর্মই প্রকৃত সারবস্তু। তাই সকলেরই ধর্মের শরণে থাকার সর্বদা চেষ্টা করা উচিত।
ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
শ্রীবাবলু মালাকার