কখনও কি মনে প্রশ্ন জেগেছে যোগ কি? কেনই বা মানব জীবনে যোগ এত গুরুত্বপূর্ণ। কেন বর্তমান আধুনিক বিশ্ব হাজার বছরের প্রাচীন এই যোগ বিজ্ঞান নিয়ে মাতামাতি করছে। কেনই বা বিশ্বব্যাপী যোগ দিবস পালন করছে বিশ্ববাসী। উক্ত বিষয়গুলো জানতে পড়তে হতে এই আর্টিকেলটি।
যোগ কি
‘শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’-তে শ্রীকৃষ্ণ যোগের সংজ্ঞা বলছেন---‘‘যোগঃ কর্মসু কৌশলম্’’ অর্থাৎ কর্মের কৌশলই যোগ৷ প্রতিমুহূর্তেই আমরা কর্ম করে চলেছি৷ এই কর্ম করার মাধ্যমেই জীবন পথে এগিয়ে চলেছি৷ এই চলার মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট ছন্দ বা কৌশল, যেমন রং, তুলি, কাগজ, থাকলেই ছবি আঁকা যায় না৷ ছবির আঁকার কৌশল আয়ত্তে আনা চাই৷ এই কৌশলকে যে যত ভালভাবে আয়ত্তে আনতে পারবে, সে তত বড়ো শিল্পী, তত বড় যোগী৷
যুক্তির খাতিরে আমরা উপলদ্বি করেছি যে, জীবনের পরম আরাধ্য (ধ্যেয়) হলেন --- চৈতন্যময় ব্রহ্ম৷ তাঁকে পাবার এষণাই জীবনের মৌলিক ধর্ম তথা মানবধর্ম৷ বিষয় ভোগে আসক্ত মনকে ব্রহ্মের অভিমুখে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন৷ জানতে হবে ধর্ম সাধনার উপযুক্ত কৌশল৷ সাধনার কৌশল যে যত ভালভাবে রপ্ত করতে পারবে সে ততই ব্রহ্মের নিকটে পৌঁছে যাবে৷ সাধনার এই কৌশলই ধর্ম-বিজ্ঞানে ‘যোগ’ নামে পরিচিত ৷ ‘যোগ’ শব্দের দু’রকমের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷ ---
- ‘যুজ্’+ ঘঞ্ প্রত্যয়= যোগ ৷ এই ‘যুজ্’ শব্দের অর্থ--- সংযোজন করা to add) যেমন ১+১= ২ --- এখানে ১ এর সাথে ১ সংযোজন করলে ‘দুই’ হবে৷ পাটিগণিতে এই ‘যোগ’-এর কথাই বলা হয়৷
- ‘যুঞ্জ্’+ ঘঞ্ প্রত্যয়= যোগ ৷ এই ‘যুঞ্জ্’ শব্দের অর্থ মিলন (Unification)৷ উদাহরণ হিসেবর বলা যায় যে চিনি ও জলকে যোগ করলে দুটি পৃথক সত্তা মিলিত হয়ে একটি সত্তাই হয়ে যাবে চিনিকণা জলেতে মিশে একাকার হয়ে যাবে৷ যোগবিজ্ঞানে এইরকম যোগের কথাই বলা হয়৷ এখন প্রশ্ণ, এই যোগ (মিলন) কাদের? মানব মনের কেন্দ্র জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা (ব্রহ্ম) ’র মিলনেই যোগ --- ‘‘সংযোগ ইত্যুক্ত জীবাত্মা-পরমাত্মামনঃ’’৷
‘যোগ’ প্রধানত ৮টি অঙ্গে আধারিত৷ এই ৮টি অঙ্গ হল---আসন, যম, নিয়ম, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ এই অষ্টাঙ্গিক যোগ অনুশীলনের মাধ্যমেই জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে৷
আরো পড়ুন- ধর্মপ্রচার - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবন ত্রিস্তরে আধৃত --- দেহ , মন ও আত্মা৷ দেহের সুষ্ঠু বৃদ্ধি বা বিকাশ হয় আসনের দ্বারা, মনের বিকাশ (বিস্তার) হয়- যম নিয়ম, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারা হয়ে ধ্যানের দ্বারা আর সমাধির মাধ্যমে মাধ্যমে জীবাত্মা পরমাত্মায় অর্থাৎ পরমব্রহ্মে বিলীন হয়ে যায়৷
প্রকৃতির সঞ্চরধারায় একদিন সৃষ্টির আদি উৎস (সূক্ষ্মতম) ‘ব্রহ্ম’ থেকে এসেছিল সে ক্রমবিবর্তনের ধারায়৷ বহু পশুজীবন অতিক্রম করে সে মানুষে উন্নীত হয়৷ বলা বাহুল্য দুর্লভ মানব জীবনই একমাত্র ব্রহ্ম সাধনার অধিকার পায়৷ অনেকেই এই বিশেষ অধিকারকে অবহেলা করে কোটি কোটি বৎসর পশুজীবনের ক্লেশ বয়ে বেড়ায়৷
প্রতিসঞ্চর ধারায় সে জীবনের বন্ধন মোচন করতে করতে ক্রমান্বয়ে আদি উৎস বন্ধনহীন (নির্গুণ) ব্রহ্মে সমাহিত হয়ে যায় ৷ ব্রহ্মে সমাহিত না হওয়ার পর্যম্ত জীবনে ঊহ-অবোহ (তরঙ্গ) থাকবেই ...... ‘বন্ধন থাকবেই ৷ অষ্টাঙ্গিক যোগের অনুশীলনই মানবজীবনকে ক্রম উত্তরণের পথে নিয়ে গিয়ে অসীম ব্রহ্মে মিলিয়ে দিয়ে সর্ববন্ধন থেকে তাকে মুক্ত করে৷ এখানেই পরমপ্রশান্তি সদচিৎআনন্দঘন অবস্থা৷
মানব জীবনে যোগের এর গুরুত্ব
সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের যোগী ঋষিরা উপলব্ধি করে আসছেন যে আমাদের জীবনে অর্থাৎ দেহ-মন ও আত্মার বিকাশে বিভিন্ন আসনের সদর্থক ভূমিকা রয়েছে৷ ‘আসন’ কী ? আসন হ’ল আরামদায়ক দেহ ভঙ্গিমা যার মাধ্যমে দেহ ও মনের বিশ্রাম হয়, আসন আমাদের দেহস্থ অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলি ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে চাপ সৃষ্টি ও চাপ বিমোচনের মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থ ও সক্রিয় করে তোলে৷ এতে করে গ্রন্থিরস (হরমোন) নি:সরণ সন্তুলিত হয়ে শরীরের সর্র্বঙ্গ সুস্থ ব্যধিমুক্ত হয়৷ প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে৷ গ্রন্থিগুলির হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে মনের ভয়, উদ্বেগ, ক্রোধ অস্থিরতা মোহ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে৷ মানসিক চাপথেকে মনকে মুক্ত করে ধৈর্য্য ও সামর্থ্য বাড়ায়, মনকে প্রশান্ত রাখে৷
অন্যদিকে, বিভিন্ন কু-অভ্যাস আহারগত ত্রুটি প্রভৃতি নানা কারণে দেহস্থ গ্রন্থিগুলি তথা অরগানগুলি দুর্বল হয়ে পড়লে হরমোন নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট হয় ও তার ফলে নানান মানসিক চাপ ও ঋণাত্মক প্রবৃত্তি জেগে ওঠে যা ক্রমান্বয়ে দেহে স্থায়ী হতে হতে নানান ব্যাধির জন্ম দেয়৷ শরীর হয়ে ওঠে ‘ব্যাধি মন্দিরম্’৷ চিকিৎসকরা বলেন যে, আমাদের দেহে অধিকাংশ ব্যাধি হল সাইকোসোমটিক্ (psycho-somatic) অর্থাৎ দেহস্থ ব্যাধির সাথে মনের নিবীড় যোগসূত্র আছে৷
আরও পড়ুন- বৃক্ষ জননী থিম্মাক্কার গল্প
মনের প্রসুপ্ত ব্যাধিই ক্রমান্বয়ে দেহে আত্মপ্রকাশ করে ও শরীরকে ক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়৷ বিভিন্ন ঋণাত্মক মানসিক বৃত্তি ও চাপ উদ্ভূত মারাত্মক ব্যাধিগুলির সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত৷ মানসিক পীড়া, অস্থিরতা, কিংবা ‘চাপা যন্ত্রণা’ থেকে আমাদের দেহের পেশী ও স্নায়ুকোষগুলি দুর্বল হয়ে যায়৷ ফলে স্নায়ুর যন্ত্রণা, দুর্বলতা, অবসাদ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়৷ থাইমাসগ্রন্থি দুর্বল হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ক্যানসারের কোষ বৃদ্ধি পেতে পারে৷ থাইরয়েডের ক্রুটির ফলে গ্যাসজনিত সম্যসা, আলসার, ডায়াবেটিস হতে পারে ৷ ‘ক্রোধ, ধৈর্যহীনতা মানসিক চাপ থেকে হৃদরোগ হবার সম্ভাবনা প্রবল৷
খাদ্যবিধির সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে বিশেষ কিছু আসন নিয়মিত অভ্যাস করলে সুস্থজীবন লাভ করা যায়৷ কিন্তু কী কী আসন দেহস্থ গ্রন্থি ও অরগান গুলিকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখে ও কীভাবে তা অভ্যাস করতে হবে এব্যাপারে সদ্গুরু বা উপযুক্ত আচার্যের নির্দেশনা অত্যাবশ্যক৷ বিভিন্ন জনের দেহের ও মনের গঠন ও তাদের সমস্যার কথা শুণে সদগুরুর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আচার্য বা আচার্যারা আগ্রহীদের আসনবিধি শিখিয়ে দেন৷
কলমে- সৌমিত্র পাল