রাম' শব্দের অর্থ আনন্দ। রাম ভগবানের আনন্দঘন স্বরূপ। রাম নামে জীব আনন্দ লাভ করে এবং মুক্ত হয়। আজ উত্তর ভারত সহ পৃথিবী জুড়ে রামনামের বন্যা। উত্তর ভারতে রামনামের বন্যা যিনি তৈরি করেছেন, তিনি হলেন আচার্য রামানন্দ এবং তাঁর কবির, রবিদাস, তুলসীদাস আদি শিষ্যরা। তাঁদের শুদ্ধ প্রচারেই ঘরে ঘরে আজ রামনাম। প্রাণীগণ নিমেষ বা নিমেষার্দ্ধকালেও যদি শ্রীরামকে স্মরণ করে, তবে তাদের সকল অজ্ঞান বিদূরিত হয়।
নিমিষং নিমিষার্দ্ধং বা প্রাণিনাং রামচিন্তনম্।
সংসারকারণাজ্ঞাননাশকং জায়তে ধ্রুবম্।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, দশম অধ্যায়, ৩৩)
"প্রাণীগণ নিমেষ বা নিমেষার্দ্ধকাল রাম চিন্তায় সংসারের অজ্ঞান বিনাশ হয়; এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই।"
আজ পৃথিবীর সকল রামভক্তদের কাছে মন্ত্রে পরিণত হয়েছে সাধক শ্রীলক্ষ্মণাচার্যের লেখা শ্রীরামচন্দ্রের একটি ভজন। ভজনটিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পতিতপাবন রাজারাম বলে বন্দনা করা হয়েছে। তিনি সত্যিই পতিতপাবন, যিনি গুহক চণ্ডালকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলেন; অহোল্যাকে পাষাণ থেকে উদ্ধার করেছিলেন; শূদ্র শবরীর মুখের ফল খেয়েছিলেন; যিনি সামান্য বানরকুলকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন; যিনি প্রজার কল্যাণের জন্যে নিজের সুখ শান্তি সকলই বিসর্জন দিয়েছিলেন; যিনি অধর্মকে নাশ করে ধর্মরাজ্য সংস্থাপিত করেছিলেন; তাই অনন্তকাল ধরে অক্ষুণ্ণ থাকবে পতিতপাবন রাজারামের মহিমা।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুশাসনের দৃষ্টান্ত হল রাম-রাজত্ব। তাই আজও পৃথিবী জুড়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সুশাসনের প্রসঙ্গ উঠলেই রামরাজ্য শব্দটি ব্যবহার করে। ভগবান শ্রীরাম এবং তাঁর রাজ্যশাসনের কথা শুধু মহর্ষি বাল্মিকী রচিত রামায়ণেই নয়; মহাভারত সহ বিবিধ পুরাণে উক্ত হয়েছে। শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যশাসনে ঋষি, দেবতা, মানুষ, পশুপাখি সহ জগতের প্রাণী মিলিত হয়ে একত্রে অত্যন্ত সম্প্রীতির সাথে বসবাস করেছিল। এ কারণেই যুগযুগ ধরে আজও মানুষ শ্রীরামচন্দ্রের জয়গাথা গেয়ে চলছে ।
ঋষীণাং দেবতানাঞ্চ মনুষ্যাণাঞ্চ সর্বশঃ।
পৃথিব্যাং সহবাসােঽভূদ্রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
(মহাভারত:দ্রোণ পর্ব,৫১.১২)
"শ্রীরাম রাজ্যশাসন করতে থাকলে, সমস্ত ঋষি, দেবতা ও মানুষেরা পৃথিবীতে একত্রে মিলিত হয়ে বাস করছিল।"
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, স্বাধীন ভারতের জন্যে একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সেই সংবিধানে একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী অলঙ্কৃত ভারতবর্ষের ইতিহাস, পুরাণ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত বাইশটি ছবি রয়েছে।এ অনন্য নান্দনিক ছবিগুলো অঙ্কন করেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু (৩রা ফেব্রুয়ারি; ১৮৮৩-১৬ই এপ্রিল; ১৯৬৬)। ছবিগুলো সংবিধানের বিভিন্ন অধ্যায়ের বিষয়বস্তু অনুসারে অঙ্কিত। সেই সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারের শুরুতেই মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র, দেবী সীতা এবং লক্ষ্মণের ছবি অঙ্কিত। সুশাসন এবং মৌলিক অধিকার রক্ষায় আদর্শিক দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতীয় সংবিধানে শ্রীরামচন্দ্রকে গ্রহণ করা হয়। কারণ শ্রীরামের রাজ্যশাসনগুণে জগৎটাই রামময় হয়ে উঠেছিল। সকলেই শান্তিতে বসবাস করত।
রামাে রামাে রাম ইতি প্রজানামভবৎ কথা।
রামভূতং জগদভূদ্ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ১২৮.১০২)
"রামরাজ্যে প্রজাবর্গের মুখে-মুখে কেবল রাম, রাম নাম এবং রামকথাই শোনা যেত। অখিল রাজ্য রামময় হয়েই থাকতো।"
রামজত্বে জগতে সকলের মুখে মুখে রাম রাম উচ্চারণ করতে করতে সমগ্র জগতই যে রামময় হয়ে গিয়েছলো, এ কথাটি রামায়ণের সাথে সাথে মহাভারতের দ্রোণপর্বেও পাওয়া যায়। রামায়ণ মহাভারত ছাড়াও বিভিন্ন পুরাণেও এ তথ্যটি পাওয়া যায়।
রামাে রামাে রাম ইতি প্রজানামভবৎ কথা।
রামাদ্রামং জগদভূদ্রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
(মহাভারত:দ্রোণ পর্ব,৫১.২২)
"শ্রীরামের রাজ্যশাসনকালে প্রজাদের মধ্যে সর্বদা রাম রাম রাম—এইরূপ আলােচনাই কেবল হত। এক শ্রীরামের রাজ্যশাসনগুণে জগৎটাই রামময় (পরম আনন্দময়) হয়ে উঠেছিল।
রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে বলা হয়েছে, যেখানে রাম রাজা নয়, সেই স্থান রাষ্ট্রই নয়। আজও শ্রীরাম রাজারূপে জগতের সকল মানুষের আদর্শ। শ্রীরাম হয়ত অবতার লীলা সংবরণ করেছেন। তিনি দেহধারী রূপে নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শিক রামরাজ্য আজও আছে। সেই আদর্শ যে রাজা হয়ে বিরাজ করে, সেই স্থান অরণ্য হলেও এক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যায়।
"যেখানে রাম রাজা নয়, সেই স্থান রাষ্ট্রই নয়। কিন্তু রাম যেখানে বাস করেন তা অরণ্য হলেও রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে যায়।"
রামরাজ্যে সত্যযুগের মতই জগতের সকলে আনন্দে ছিলো। তাই আজও সেই আদর্শকে জাতি আদর্শিক কাঠামো হিসেবে গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করবে, তারাও ত্রেতাযুগের রামরাজ্যের মতই সর্বদা আনন্দময় চিত্তে বসবাস করবে। যে রাজ্যে জনগণ সর্বদা প্রসন্ন, সুখী , সন্তষ্ট, হৃষ্টপুষ্ট, ধার্কিক প্রজাহিতৈষী প্রজাকল্যাণকামী রাজ্যকেই বলে রামরাজ্য। সেই রাজ্যে কোন রোগ-ব্যধি থাকে না, দুর্ভিক্ষের ভয় থাকে না। সবাই শতবছর পরমায়ু ভোগ করে। কোন পিতামাতাকে তাঁর সন্তানের অকালে মৃত্যুমুখ দর্শন করতে হয় না। পতিপরায়ণা নারীদের বৈধব্যদশা ভোগ করতে হয় না। মনুষ্য সহ জগতের কোন প্রাণীরই অগ্নি ভয়, জলে ডুবে যাওয়ার ভয় এবং প্রবল ঝড়-ঝঞ্জার ভয় থাকে। রামরাজ্যে রোগ ব্যাধি তো দেহে আক্রমণ করতে পারে না; এমনকি সামান্য ল জ্বরের ভয়ও থাকে না। সম্পদের জনকল্যাণমুখী সুষম বণ্টন হওয়ায় রামরাজ্যে কেউ ক্ষুধার্ত থেকে ক্ষুধায় কষ্ট পায় না। সকলের ঘরের দ্বার খোলা রেখে নিশ্চিন্ত মনে শয়ন করে। কোন চোরের ভয় থাকে না। রামরাজ্যে জনকল্যাণমুখী বিবিধ প্রকারের কর্মকাণ্ডের কারণে নগর এবং রাষ্ট্রগুলো ধনধান্যে পরিপূর্ণতা পেয়ে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
প্রহৃষ্টমুদিতা লোকস্তষ্টঃ পুষ্ট সুধার্মিকঃ ।
নিরাময়ো হ্যবোগশ্চ দুর্ভিক্ষ-ভয়বর্জিত।।
ন পুত্রমরণং কোচিদ্ দ্রক্ষ্যন্তি পুরুষাঃ ক্বচিৎ।
নার্যশ্চাবিধবা নিত্যং ভবিষ্যন্তি পতিব্রতাঃ।।
ন চাগ্নিজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপ্সু মজ্জন্তি জন্তবঃ।
ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা।।
ন চাপি ক্ষুদ্ভয়ং তত্র ন তস্করভয়ং তথা।
নগরাণি চ রাষ্ট্রাণি ধনধান্যযুতানি চ।।
নিত্যং প্রমুদিতাঃ সর্বে যথা কৃতযুগে তথা।
(রামায়ণ : আদিকাণ্ড, ১.৯০-৯৪)
"রামরাজ্য জনগন প্রসন্ন, সুখী, সন্তষ্ট, হৃষ্টপুষ্ট ধার্মিক এবং ব্যধিমুক্ত হবে; দুর্ভিক্ষের ভয় তাদের থাকবে না।
কোন পুরুষ কখনো পুত্রের মৃত্যু দর্শন করবে না, নারীগন হবেন অবিধবা ও পতিপরায়ণা।
কোন প্রাণীরই অগ্নি ভয়, জলে ডুবে যাওয়ার ভয় এবং প্রবল ঝড়-ঝঞ্জার ভয় থাকবে না, এমনকি জ্বরের ভয়ও থাকবে না।
সেই রামরাজ্যে ক্ষুধার ভয় এবং চোরের ভয় থাকবে না। নগর এবং রাষ্ট্রগুলো ধনধান্যে সমৃদ্ধ থাকবে।
যেমন সত্যযুগের মতই রামরাজ্যে জগতের সকলেই
নিত্য আনন্দময় থাকবে।"
রাষ্ট্রে বিধবাদের বৃদ্ধি, সিংহাদির ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়, ব্যবহারিক অনর্থ, বাল্যমৃত্যু, পারস্পরিক বিবাদ, বংশচ্ছেদন ইত্যাদির কারণ নেতা রাজার অনুচিত শাসন। বাল্যবিবাহ, বৃদ্ধ বিবাহ, বন-জঙ্গলের অনিয়ম, প্রজাদের অসুরক্ষা, চিকিৎসার জন্য চিকিৎসালয় এবং খাদ্যবস্তুর ন্যূনতা রাজ্যের দুর্ব্যবস্থার পরিণাম -এ সকল কিছুই কিছুই না রামরাজ্যে।রামায়ণের আদিকাণ্ডের সাথে সাথে যুদ্ধকাণ্ডেও আরেকবার রামরাজ্যের বর্ণনা করা হয়েছে। রামরাজ্যের বিষয়টি উপলব্ধি করাতেই আদিকবি বাল্মিকী একাধিক স্থানে এই রামরাজ্যের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন।
ন পর্যদেবেন বিধবা ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম্৷
ন ব্যধিজং ভয়ং চাসীদ্ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
নির্দস্যুরভবল্লোকো নানর্থং কশ্চিদস্পৃশৎ ।
ন চ স্ম বৃদ্ধা বালানাং প্রেতকার্যানি কুৰ্বতে।।
সর্বং মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্মপরোঽভবৎ।
রামমেবানুপশ্যন্তো নাভ্যহিংসন্ পরস্পরম্।।
আসন্ বর্ষসহস্রানি তথা পুত্রসহশ্রিণঃ।
নিরাময়া বিশোকাশ্চ রামে রাজ্যং প্রশাসতি।।
(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড,১২৮,৯৮-১০১)
"শ্রীরামের শাসনকালে বিধবাদের ক্রন্দন শোনা যেত না। সর্পাদি শ্বাপদ সহ কোন হিংস্র প্রাণীর ভয় ছিলো না, ব্যাধি থেকে উৎপন্ন ভয়ও ছিলো না।কোন রোগ ব্যাধির কাউকে কষ্ট দিতো না। দেশের কোথাও চোর, ডাকাতের ভয় তো দূরে থাক, তাদের নাম পর্যন্ত শোনা যেত না। কেউ কারো প্রতি অনর্থ বা পাপকর্ম করতো না। বৃদ্ধদের সম্মুখে কোন নবীন বা শিশুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার প্রয়োজন পড়তো না। অর্থাৎ অকালে কারই মৃত্যু হত না। সকলেই সন্তুষ্ট এবং আনন্দিত চিত্তে ছিলো।সকলেই ধর্মপরায়ণ হয়ে ধর্ম আচরণ করতো।শ্রীরামকে স্মরণে রেখে একের সাথে অন্যে হিংসা করতো না। অনেক পুত্র-পৌত্র যুক্ত বংশ সহস্র বর্ষ পর্যন্ত জীবিত থাকতো। প্রজারা রোগ ও শোক থেকে মুক্ত হয়ে সানন্দে বসবাস করতো।"
রামায়ণের একাধিক স্থানেই রামরাজ্যে শ্রেষ্ঠত্বের কথা আছে। আদিকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ডের পরে উত্তরকাণ্ডেও বিষয়টি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সকলের প্রতিই রামরাজ্যে ন্যায় করা হত। প্রজাদের কখনও কোন সামাঅন্যতম অসুবিধা হত না। তাই শ্রীরামের রাজ্য তাঁর রাজদরবারে কখনও কোনো অভিযোগকারী কারো প্রতি অভিযোগ জানাতেও আসতো না। সকলেই অত্যন্ত প্রসন্ন ছিলো।
নাধয়ো ব্যাধয়শ্চৈব রামে রাজাং প্রশাসতি।
পক্কসস্যা বসুমতী সর্বৌষধিসমন্বিতা॥
ন বালো প্রিয়তে তত্র ন যুবা ন চ মধ্যমঃ ।।
ধর্মেণ শাসিতং সর্বং ন চ বাধা বিধীয়তে৷৷
দৃশ্যতে ন চ কার্যার্থী রামে রাজ্যং প্রশাসতি।
প্রাঞ্জলির্ভূত্বা রামায়ৈবং নাবেদয়ৎ।
অথ রামঃ প্রসন্নাত্মা সৌমিত্রিমিদমব্রবীৎ।
ভূয় এব তু গচ্ছ ত্বং কার্যিণঃ প্রবিচারয়।।
সম্যক্ প্রণীতয়া নীত্যা নাধর্মো বিদ্যতে ক্বচিৎ।
তন্মাদ্ রাজভয়াৎ সর্বে রক্ষন্তীহ পরম্পরম্ ।।
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, প্রক্ষিপ্ত সর্গ, ১.৮-১২)
"শ্রীরামের রাজ্য শাসন কালে কারো কোনো শারীরিক রোগ হত না এবং মানসিক চিন্তাও কষ্ট দিত না। পৃথিবীতে সর্বপ্রকার ওষধি (অন্ন-ফল ইত্যাদি) উৎপন্ন হতো এবং পক্ক শস্য ক্ষেতে শোভা পেত।
শ্রীরামের রাজ্যে কোনো বালকের, যুবকের বা মধ্য বয়স্ক পুরুষের (অকালে) মৃত্যু হত না। সকলের প্রতিই ন্যায় করা হত। কারো কখনও কোনো অসুবিধা হত না।
শ্রীরামের রাজ্য শাসনকালে দরবারে কখনও কোনো অভিযোগকারী ছিল না। লক্ষ্মণ হাত জোড় করে শ্রীরামচন্দ্রকে রাজ্যের এই অবস্থা অবগত করালেন।
তারপর প্রসন্নচিত্তে শ্রীরাম সুমিত্রাকুমারকে পুনর্বার বলেন – ‘লক্ষ্মণ ! তুমি আবার যাও এবং ভালো করে সন্ধান করো।"
শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে জগতের মানুষ আজও যে রাম এবং রামরাজ্যের কথা বলে। কারণ শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন বিবিধ গুণে গুণান্বিত এক আদর্শ মানব। এই বিবিধ গুণাবলি কারণেই তাঁকে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র বলে অবিহিত করা হয়। তিনি যেমন প্রজাসকলের মনোরঞ্জনের সর্বদা প্রচেষ্টা করতেন, তেমনি পিতা দশরথের গুণে গুণান্বিত হয়ে নিজ কিরণমালায় এক জাজ্জ্বল্যমান প্রদীপ্ত সূর্যের মত সকলের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিলেন। তিনি ছিলেন অজেয়, পরাক্রমী এবং সদাচারসম্পন্ন লোকপাল। তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের রাজা। তাই রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডেই বলা হয়েছে, সেই রামকে পৃথিবীর সকল প্রজা প্রভুরূপে কামনা করতেন।
"প্রজাসকলের মনোরঞ্জন ও পিতার প্রীতিকর কার্যগুণে রাম, স্বীয় কিরণমালায় প্রোজ্জ্বল সূর্যের মতো প্রদীপ্ত (সকলের আকর্ষণীয়) হয়ে উঠেছিলেন।
এইরকম অজেয় পরাক্রমী সদাচারসম্পন্ন লোকপাল সদৃশ সেই রামকে পৃথিবী তথা পৃথিবীর সকল প্রজা প্রভুরূপে কামনা করতেন।"
শ্রীরাম আজও ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর মানুষের হৃদয়ে। পৃথিবী ব্যাপী ছড়ানো রয়েছে নামের নাম এবং সংস্কৃত। আজও পৃথিবীতে এমন মানুষেরা আছেন, যাদের শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সারা গায়ে 'জয় শ্রীরাম', 'রাম রাম', 'শ্রীরাম' লিখে রাখে। গুজরাটে সোমনাথ মন্দিরে পূজা দেয়ার সময় এমন বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম আমি জানতে পারি। আমার পাশে বেশ কয়েকজন নারীপুরুষ পূজা দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তাদের দেহের উর্ধাঙ্গ সহ সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলে রামনাম লেখা। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম, আমরা এই তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত মানুষেরা মুখে একটি সামান্য দাগ বা তীল হলেও এর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যাই। আর এরা সারা মুখমণ্ডল সহ দেহতে রামনামের উল্কি করা। দুই অক্ষরের একটা শব্দ— ‘রাম’।
তাদের থেকে শুনলাম, শুধু একবার ‘রাম’ শব্দের ‘র’ উল্কি আঁকতে তিনটে ছুঁচ শরীরে কুড়ি বার ফোটাতে হয়। শুধু 'র' লিখতেই যদি কুড়িবারের মত ছুঁচ শরীরে ফোটাতে হয়। সেই হিসেবে সারাদেহে রামনামের লেখা হাজার হাজার উল্কি করতে, কত সহস্রবার ছুঁচ ফোটাতে হয়েছে তাদের শরীরে ভাবতেই আমার চোখে জল চলে এলো। উপলব্ধি করতে পারলাম শ্রীরামচন্দ্র এবং তাঁর রামরাজ্যের আদর্শ আজও কতটা সক্রিয় সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে। মানুষগুলোর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তারা পিছিয়ে পরা তথাকথিত শূদ্র শ্রেণীর। অথচ ভারতবর্ষের কিছু বুদ্ধিজীবীদের মুখে হরহামেশাই শুনতে পাই যে এই শূদ্র শ্রেণীর মানুষেরা নাকি শ্রীরামচন্দ্রকে পছন্দ করে না। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে না এবং পূজাও করে না। কথাটি যে কতটা অসত্য, তা এই পিছিয়ে পরা মানুষদের সাথে কথাবার্তায় কিছুটা সময় কাটালে এমনিতেই বুঝে যাবে।
বর্তমানে কিছু বামপন্থী এবং তথাকথিত দলিত রাজনীতির ধারক বাহক কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী শুধুই রাজনীতির স্বার্থে শ্রীরামচন্দ্র এবং তাঁর আদর্শের বিরোধিতা করছেন। এদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি আরও একধাপ এগিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন বুদ্ধদেবকে। কিন্তু এই ব্যক্তিগুলোর একবার ভেবে দেখেন না যে, যিনি রাম এবং তিনিই বুদ্ধ। দুজনেই ভগবান বিষ্ণুর অবতার। তাই এদের মধ্যে ভেদ নেই। আরেকটি তথ্য আমরা অনেকেই জানি না যে, শ্রীরামচন্দ্র এবং গৌতমবুদ্ধ একই বংশের ছিলেন। তাঁরা দুজনেই সূর্যবংশীয় রাজা ইক্ষ্বাকুর বংশধর।
রাজা ইক্ষ্বাকুর বংশের শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন রাজা এবং গৌতমবুদ্ধ ছিলেন শ্রীরামচন্দ্রের পরবর্তীতে ইক্ষ্বাকুবংশ থেকে উদ্ভূত শাক্যবংশের যুবরাজ। শ্রীরামচন্দ্রের সন্তান লব-কুশ। এই লব-কুশেরই উত্তরপুরুষ গৌতমবুদ্ধ। তাই রাম এবং বুদ্ধকে প্রতিপক্ষ সাজিয়ে রাজনীতি করার মত মূর্খতা আর নেই। বিষয়টি সাধারণ মানুষকে উস্কানি দিয়ে নিজেদের রাজনীতির ঝুলি ভরা ছাড়া আর কিছুই নয়।আজও অসংখ্য মানুষের বেঁচে থাকার মন্ত্র শ্রীরামচন্দ্রের আদর্শে এবং তাঁর পবিত্র নাম। ছত্তীসগঢ়ের মহানদীর তীরে আজও অসংখ্য মানুষ রামনামের উল্কি শরীরে ধারণ করে থাকে। এদের অধিকাংশই গুরু শ্রীঘাসীরাম প্রবর্তিত সৎনামি সম্প্রদায়ের।