সনাতন ধর্ম শাশ্বত। সৃষ্টির শুরু থেকেই এ ধর্ম অবিচ্ছিন্নভাবে আজও বহমান। কোন সাল বা তারিখ দিয়ে এ ধর্মকে সীমাবদ্ধ করা যায় না।স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক এ শাশ্বত ধর্ম প্রবর্তিত। পরমেশ্বর কর্তৃক এ জগতের এবং ধর্মের যুগপৎ উৎপত্তি হয়েছে। তাই পৃথিবীর পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাসের যত পেছনেই যাওয়া যায় সেখানেই সনাতন ধর্মের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ ধর্ম কোন ব্যক্তি কর্তৃক প্রবর্তিত ব্যক্তি সর্বস্ব মতবাদ নয়। যে এ ধর্ম থেকে একজন ব্যক্তিকে বাদ দিলেও সনাতন ধর্মের সামান্য হেলদোল হয় না। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে প্রবর্তক ব্যক্তিকে বাদ দিলে সেই ধর্মীয় মতবাদের কোন অস্তিত্বই থাকে না; মতবাদটি সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অবতারবাদ সনাতন ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাস।
পরমেশ্বর ভগবান জগত এবং জীবের কল্যাণে শরীর ধারণ করে আসেন। এসে তাঁর সৃষ্টিকে স্বয়ং রক্ষা করেন। ভগবান সম্পূর্ণ জগতব্যাপী আছেন, এরপরেও লোকশিক্ষার জন্যে এ জগতে মূর্তিমান হয়ে সাধুদের পরিত্রাণ দুষ্টদের বিনাশ করেন। ভগবানের ইচ্ছাতেই সকল কার্য সাধিত হয়। তিনি চাইলে শুধু তাঁর ইচ্ছা শক্তি দিয়েই দুর্জনকে বিনাশ করে ধর্মসংস্থাপন করতে পারেন। অথবা তিনি তাঁর পক্ষ থেকে কোন দেবদূতকে প্রেরণ করতে পারেন ; কিন্তু তিনি তা না করে ধর্মসংস্থাপনের জন্যে স্বয়ং নিজেই জীবের মাঝে আসেন। একেই তাঁর অচিন্ত্য লীলা বলে শাস্ত্রে অবিহিত করা হয়েছে।
সেই অনন্ত এক পরমেশ্বরই জগতের কল্যাণে বিভিন্ন রূপে এসেছেন। বিভিন্ন কার্য সাধন করেছেন। কখনো তিনি ধন্বন্তরি নামে চিকিৎসকরূপে এসেছেন, কখনো অসুরদের মোহিত করতে মোহিনীরূপে, বুদ্ধরূপে এসেছেন, কখনো জগতের পুরুষ-প্রকৃতি শিক্ষা দিতে কপিলরূপে এসেছেন। কখনো তিনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ সহ অর্ধ মানব অর্ধ পশুরূপে নরসিংহরূপে এসেছেন। বিভিন্নরূপে বিভিন্নভাবে তিনি এ জগতে এসেছেন। সেই চিন্তার অতীত ব্রহ্মেরই সৃষ্টি,পালন এবং সংহার এ তিনিটি প্রধান কার্যের তিনটি রূপ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর।
আবার সেই অব্যক্ত পরমেশ্বরই জগতে অবতাররূপে এসে ব্যক্ত হয়ে মূর্তিমান দৃষ্টিগ্রাহ্য হন। পরমেশ্বরের অসংখ্য অবতাররূপের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠরূপ হল দুটি। প্রথমজন হলেন ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র এবং দ্বিতীয়জন হলেন দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র-শ্রীকৃষ্ণ ভারতবর্ষের ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি সভ্যতার দুই আধারস্তম্ভশীলা। আমরা যদি কল্পনা করি, সেই আধারশীলারূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান শ্রীরাম আমাদের ধর্মে আপাতত নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গত পাঁচহাজার বছর পূর্বের কংসের কারাগারে আবির্ভূত রূপকে বাদ দিলেও আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অচিন্ত্য ব্রহ্মরূপে সেই তাঁকেই উপাসনা করতে পারি। আবার প্রকৃতির তিনগুণ ভেদে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর রূপে সেই তাঁরই শরণ নিতে পারি।
তবে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপকে বাদ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। শুধুই সনাতন ধর্মের শাশ্বত সত্ত্বাকে বোঝানো সুবিধার্থে এ বাদ দেয়া কথাটির অবতারণা। আমরা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি, অবতার বা অবতারের সর্বশ্রেষ্ঠ অবতার যাঁরা ; তাদেরও সনাতন ধর্ম থেকে সরিয়ে দেয়ার কল্পনা করা হলেও সনাতন ধর্ম ধূলিসাৎ হয় না। কিন্তু অন্যান্য ব্যক্তিগতকেন্দ্রিক মতবাদের প্রবর্তক ব্যক্তিকে সরিয়ে দিলে, সেই সকল ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মীয় কাঠামোই সম্পূর্ণভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। সনাতন ধর্মে অবতাররূপে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ না থাকলেও বা তাঁদের কেউ অবতাররূপে না মানতে চাইলেও খুব একটা সমস্যা নেই। সেই ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণই আছেন সকল জীবের উপাস্য অচিন্ত্য ব্রহ্মরূপে। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর,দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতীরূপে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই একজনকেই আমরা উপাসনা করি। সনাতন ধর্ম এমন একটি শাশ্বত একটি ধর্ম যে, একজন ব্যক্তিকে সরিয়ে দিলেও বা সনাতন ধর্ম প্রবাহ থেকে পরমেশ্বরের একটি অবতাররূপকে সরিয়ে দিলেও এ সনাতন ধর্মস্তম্ভের চ্যুতি ঘটে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিবিধ মূর্তির কথা মহাভারত সহ একাধিক শাস্ত্রে বলা আছে। মহাভারতের দ্রোণপর্বে ভগবান নিজেই একইসাথে তাঁর বিবিধ মূর্তিতে অবস্থিতির কথা বলেছেন।
একা মূর্তিস্তপশ্চর্যাং কুরুতে মে ভুবি স্থিতা।
অপরা পশ্যতি জগৎ কুর্বাণং সাধ্বসাধুনী।।
অপরা কুরুতে কর্ম মানুষং লােকমাশ্রিতা।
শেতে চতুর্থী ত্বপরা নিদ্রাং বর্ষসহস্রিকাম্।।
(মহাভারত:দ্রোণ পর্ব,২৭.২৫-২৬)
"একটি মূর্তিতে আমি নারায়ণরূপে ভুবনে তপস্যা করি, পরব্রহ্মরূপ দ্বিতীয় মূর্তি জগতের ভাল-মন্দ কার্য দর্শন করি।
মৎস্য-কূর্মাদি অবতাররূপ তৃতীয় মূর্তিতে মনুষ্যলােকে থেকে মানুষের মত কার্য করে ধর্মসংস্থাপন করি এবং চতুর্থী মূর্তিতে অনন্তকালব্যাপী কালনিদ্রায় কারণসমুদ্রে শায়িত থাকি।"
যেমন ব্রহ্মরূপে তিনি আছেন, তেমনি তিনি আবার মানুষের কল্যাণের জন্য অবতার রূপেও আসেন। তিনিই ব্রহ্মা হয়ে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু হয়ে পালন করেন আবার তিনিই মহেশ্বর শিবরূপে বিনাশ করেন। পরমেশ্বরের অনন্তরূপী এ বিষয়টি আমরা না বুঝে অহেতুক ভুল বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আমাদের অনেকেরই ধারণা যে, ঈশ্বর বুঝি পাঁচতলা, সাততলা বা দশতলা আকাশের উপরে পাপপুণ্যের ক্যালকুলেটর হাতে আসনে বসে আছে। তিনি যখন অবতাররূপে আসেন তখন সে আসনটি খালি পরে থাকে। আসলে বিষয়টি ঠিক এরকম নয়। এরকম যারা ভাবেন, তারা সত্যিকার অর্থে সনাতন-দর্শন ভাল করে জানেন না বা বোঝেন না বলেই এ সমস্যাটি হচ্ছে। পরমেশ্বর এমনিতেই জগতে নিমিত্ত কারণ এবং উপাদান কারণরূপে বিরাজমান। তিনি জগতকে যে চেতন সত্ত্বার মাধ্যমে পরিচালনা করছেন, তাকে নিমিত্ত কারণ বলে। আর প্রত্যেকটি উপাদানের সাথে তিনি আছেন, তাকে উপাদান কারণ বলে। অর্থাৎ এ জগতের জড়-চেতন প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত আছেন পরমেশ্বর। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। পরমেশ্বর একাধারে যেমন মাটির হাড়ি-পাতিল তৈরি করার কুমার; তেমনি আবার তিনি জল, মাটি, কুমারের চাকা সহ হাড়ি-পাতিল তৈরির সকল উপাদান।