শ্রীঅরবিন্দ ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ, যিনি পেশায় ছিলেন রংপুর জেলায় কর্মরত একজন খ্যাতিমান সার্জন এবং মাতা ছিলেন স্বর্ণলতা দেবী। তাঁর মাতামহ ছিলেন সুবিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজের নেতা রাজনারায়ণ বসু। শ্রীঅরবিন্দ বাল্যকালে ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গমন করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাস করে দেশে ফিরে এসে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পরেন।
রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের চরমপন্থী অংশের নেতা। বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি ১৯০৫-১৯১১ সালে গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেদগবেষক তিনি। তিনিই প্রথম আমাদের দেখিয়ে দেন যে -বেদের আক্ষরিক অর্থ নয়, প্রতীকাত্মক আধ্যাত্মিক অর্থই প্রধান। যাস্কের নিরুক্তানুসারে তিনি দেখান - বৈদিক 'গো' শব্দটি যেমন প্রকাশরশ্মির প্রতীক এবং 'অশ্ব' শব্দটি শক্তি, অধ্যাত্মবীর্য ও তপোবলের প্রতীক।
অথচ আমরা যাস্কের নিরুক্তকে অনুসরণ না করে সর্বক্ষেত্রে 'গো' শব্দটির গরু অর্থ করে প্রতিদিন অনেক অনর্থ করে যাচ্ছি এবং বেদ সম্পর্কিত প্রচুর ভুল ধারণা জন্ম দিয়ে চলছি প্রতিনিয়ত।
"রহস্যবিদ্যা গোপন রাখতেই হবে, অতএব প্রতীক ও প্রতীকাত্মক শব্দের সহায়তা অনিবার্য। অর্থ-গুপ্তির নিমিত্ত ছদ্মাবরণের (মুখোস) প্রয়োজনে ঋষিরা দ্ব্যর্থ-বোধক শব্দের আশ্রয় নিলেন। এ-কৌশলটি অতিশয় সুগম সংস্কৃত ভাষায় কারণ একই পদের নানা ভিন্নার্থ-সম্ভাব্যতা এই ভাষার বৈশিষ্ট্য,—যে কারণে ইংরাজী ভাষায় অনুবাদ অত্যন্ত দুরূহ এবং স্থানে স্থানে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলা চলে। যেমন, পশু-সংজ্ঞক ‘গো’ শব্দের আর এক অর্থ ‘আলোক’ বা ‘আলোক-রশ্মি’, ‘প্রকাশ-রশ্মি'।
এই অর্থে পদ টির প্রয়োগ দৃষ্ট হয় কতিপয় ঋষির নামকরণে, যথা ‘গোতম’ অর্থাৎ উজ্জ্বলতম, ‘গবিষ্ঠির’ অর্থাৎ আলোক-আকাশে স্থির জ্যোতি। বৈদিক ‘গো-বৃন্দ’ শব্দটি গ্রীসদেশের পৌরাণিক গাথার পরিচিত সত্য-জ্যোতি-জ্ঞান সূর্যের রশ্মি অর্থে প্রযুক্ত, ‘গো-যূথ’ শব্দের সম-পর্যায়ী। কতকগুলি সূক্ত থেকে সঙ্কলিত এই অর্থ সর্বত্র ব্যবহাত হলে কোথাও অর্থবোধে অসঙ্গতি পাওয়া যায় না। প্রচলিত অর্থে, ‘ঘৃত’-শব্দটিতে বুঝায় পরিশোধিত নবনীত জাত আজ্য-পদার্থ, যজ্ঞীয় কর্মে মুখ্য বিশেষাঙ্গ উপাদানগুলির অন্যতম।" (শ্রীঅরবিন্দ ২০০৭: ১২)
শ্রীঅরবিন্দ বিশ্বাস করতেন যে, বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্রসহ ভারতবর্ষে উৎপন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়গুলির উৎস বেদ। বেদের মধ্যে এ সকল মতপথেরই প্রাথমিক রূপ পাওয়া যায়। তাই বেদের গর্ভেই ভারতবর্ষীয় সাকার নিরাকার সকল মহৎ উপাসনা প্রণালীগুলিরই উদ্ভব।
"বাস্তবিক বৈদিক উৎস থেকেই বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র, দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি ও মহৎ ভারতীয় উপাসনা-প্রণালীগুলির উদ্ভব। বৈদিক মূলে আমরা দেখতে পাই পরবর্তী ভারতীয় চিন্তার ভিত্তি গত ধারণাগুলির মূল বীজ বা তাদের প্রাথমিক, এমনকি তাদের আদিম রূপ। অতএব ভারতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের আরও সারবান্ তুলনামূলক গবেষণার স্বাভাবিক উৎস পাওয়া যাবে। অদৃঢ় জল্পনার মধ্যে বিচরণের বা অসম্ভব রূপান্তর ও অব্যাখ্যাত সংক্রমণের পরিবর্তে আমরা পাব যুক্তির সন্তোষজনক স্বাভাবিক ও ক্রমিক বিকাশের সূত্র।"(শ্রীঅরবিন্দ ২০০৭: ২৯)
শ্রীঅরবিন্দের জীবনীতে পাওয়া যায়, ১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন তার পার্থিব শরীরকে ঘিরে ছিলো এক জ্যোতির্ময় বলয়। শ্রীঅরবিন্দ বাঙালি হলেও তাঁকে বাঙালিরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বাঙালিরা না পারলেও দক্ষিণ ভারতের মানুষেরা তাঁর আদর্শকে কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত করতে পেরেছে সমাজের মাঝে। দক্ষিণ ভারতের পণ্ডিচেরীর (পুদুচেরি) অরোভিল এর বাস্তব প্রমান।পণ্ডিচেরীতে শ্রীঅরবিন্দের আদর্শ যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় ভারতের আর কোন দ্বিতীয় প্রদেশ নেই যেখানে একজন ব্যক্তির মতাদর্শ দ্বারা পুরো প্রদেশ এতটা প্রভাবিত। পুরো প্রদেশের সর্বক্ষেত্রেই শ্রীঅরবিন্দকে এবং তাঁর ভাবাদর্শকেই চোখে পরে।
তথ্য সহায়তা:
১.শ্রীঅরবিন্দ, বেদরহস্য (পূর্বার্দ্ধ), শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পুদুচেরি: ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০০৭