হিন্দু জাতি সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে, নৃত্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে। সর্বোপরি সংস্কৃতির প্রত্যেকটি উপাদানের মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করে। পৃথিবীর একটি অনন্য সমৃদ্ধ জাতি হিন্দু। হিন্দু জাতি বিশ্বাস করে সর্বভূতে, অর্থাৎ জগতের প্রত্যেকটি জীবের মাঝে পরমাত্মারূপ ব্রহ্ম বিরাজিত। সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদের শাণ্ডিল্য ঋষির দৃষ্ট 'শাণ্ডিল্য-বিদ্যা' অংশে বলা হয়েছে :
সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত।
অথ খলু, ক্রতুময়ঃ পরুষো যথাক্রতুরস্মিঁল্লোকে
পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি স ক্রতুং কুৰ্বীত॥
(ছান্দোগ্য উপনিষদ:৩.১৪.১)
"এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই ব্রহ্ম, কারণ তাঁর থেকেই সকল কিছু উৎপন্ন হয়ে তাঁতেই লীন হয় এবং তাঁহাতেই জীবিত থাকে । এই তত্ত্ব জ্ঞাত হয়ে শান্ত হয়ে তাঁর উপাসনা করবে । মানুষমাত্রই সঙ্কল্পযুক্ত, এই পৃথিবীতে মানুষের যেমন সঙ্কল্প, অধ্যবসায় বা কর্ম— হবে, এই পৃথিবী বা দেহ ছেড়ে যাওয়ার পরও সেই রকমই হয় । তাই এ ভাবটি দৃঢ়হৃদয়ে অবলম্বন করে উপাসনা করবে।"
হিন্দু জাতি নিজেরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, জগতকে শেখায়, "যত্র জীব, তত্র শিব"। ধনী গরিব প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই শিবরূপ পরমেশ্বর নিবাস। সনাতন ধর্মে জীবদেহকে মন্দির বলা হয়েছে। তাই জগতের সকল জীবকেই পবিত্র এবং একাত্বতার দৃষ্টিতে দেখতে শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মনে সর্বদা সোঽহংভাব এনে নিজের মধ্যে পরব্রহ্ম শিবের ভাব যেমন উপলব্ধি করতে হবে, তেমনি জগতের প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই শিবরূপ ব্রহ্মের অধিষ্ঠান দর্শন করতে হবে। জীবই শিব এবং শিবই জীব। কিন্তু জীব মায়ার আবরণে আবদ্ধ থাকায় সে উপলব্ধি করতে পারে না যে, তাঁর আত্মাই অদ্বিতীয় শিবময়। কর্মের বদ্ধনে আবদ্ধ যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই তাকে জীব বলা হয়। কিন্তু যখন জীব অজ্ঞানের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে তখনই সে সদাশিবময় হয়ে যায়। তাই জগতের কোন জীবকেই ছোট করতে নেই, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই, হিংসা করতে নেই, সকল জীবের মাঝে একই পরমেশ্বরের দিব্য জ্যোতি বিরাজ করে। কুলার্ণবতন্ত্রে বলা হয়েছে:
দেহো দেবালয়ো দেবি জীবো দেবঃ সদাশিবঃ।
ত্যজেদজ্ঞাননির্মাল্যং সোঽহংভাবেন পূজয়েৎ ॥
জীবঃ শিবঃ শিবো জীবঃ স জীবঃ কেবলঃ শিবঃ।
পাশবদ্ধঃ স্মৃতো জীবঃ পাশমুক্তঃ সদাশিবঃ ॥
তুষেণ বদ্ধো ব্রীহিঃ স্যাত্তুষাভাবে হি তণ্ডুলঃ ।
কৰ্মবদ্ধঃ স্মৃতো জীবঃ কর্মমুক্তঃ সদাশিবঃ ॥
(কুলার্ণবতন্ত্র: নবম উল্লাস, ৪১-৪৩)
"হে দেবী! দেহ দেবালয়। জীব দেব সদাশিব অজ্ঞাননির্মাল্য পরিত্যাগ করতে হবে আর পূজা করতে হবে সোঽহংভাবে ( আমি সেই পরব্রহ্ম শিব এইভাবে )।
জীব শিব । শিব জীব। সেই জীব অদ্বিতীয় শিব। পাশবদ্ধ হলে বলা হয় জীব এবং পাশমুক্ত হলে তাঁকেই বলে সদাশিব।
তুষের দ্বারা আবৃত থাকলে ধান এবং তুষ না থাকলে তাকে বলে চাল। তেমনি কর্মবদ্ধ হলে বলা হয় জীব, পক্ষান্তরে কর্মমুক্ত হলে সেই জীবই সদাশিব।"
হিন্দু জাতি সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণকামী একটি জাতি।প্রত্যন্ত গ্রামের একটি বেলতলায় যদি কোন পূজা অনুষ্ঠিত হয়, সে পূজাতেও জগতের সকল জীবের কল্যাণ কামনা করা হয়। প্রত্যেকটি জীবের মঙ্গল কামনা করা হয়, মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করা হয়; জগতের কোন প্রাণী যেন দুঃখভোগ না করে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ প্রত্যেকটি পূজার আগে এবং বেদপাঠের আগে বৈদিক শান্তিমন্ত্র পাঠ করে জগতের সকল জীবের শান্তি কামনা করে। এ বৈশ্বিক সাম্যবাদী একাত্মবাদী ধারণা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্তে এবং শাশ্বত চেতনায়।শুধু মানুষ নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জীবের তারা শান্তি, কল্যাণ এবং ঋদ্ধি কামনা করে। এমন একটি সংস্কৃতি নির্ভর শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায় জগতে বিরল। সনাতন ধর্ম যেখানে শিক্ষা দেয়, শুধু মানুষ নয় জগতের প্রত্যকটি জীবেত মধ্যেও শিবরূপ ব্রহ্মের অধিষ্ঠান রয়েছে। তাই জগতের প্রত্যেকটি জীবের সেবার মাধ্যমে শিবরূপ ব্রহ্মেরই সেবা করা হয়।অথচ জগতের অনেক জাতির মধ্যে বৈশ্বিক সাম্যবাদী চিন্তার ভয়াবহ অভাব পাওয়া যায়। তারা ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করতেও পিছপা হয় না।যা মনুষ্যত্বের জন্য লজ্জা এবং পরিতাপের। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাতেও পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে 'মানসী' কাব্যগ্রন্থের 'বঙ্গবীর' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
"কেহ মাথা ফেলে ধর্মের তরে,
পরহিতে কারো মাথা খ'সে পড়ে,
রণভূমে কেহ মাথা রেখে মরে
কেতাবে রয়েছে লেখা।
আমি কেদারায় মাথাটি রাখিয়া
এই কথাগুলি চাখিয়া চাখিয়া
সুখে পাঠ করি থাকিয়া থাকিয়া,
পড়ে কত হয় শেখা!"