সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ ত্রিগুণই, জীবকে পরিচালিত করে

সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ ত্রিগুণই,  জীবকে পরিচালিত করে

আমরা সুখেদুঃখে, আনন্দবেদনার সাগরে ভেসে চলা মানুষ ।জগতে কেউ অনন্ত পাপি বা অনন্ত পুণ্যবান নয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এ ত্রিগুণ দ্বারা প্রতিনিয়ত আছন্ন হয়ে আছি আমরা। এ ত্রিগুণকে সহসাই কেউ আমরা চাইলেই অতিক্রম করতেই পারি না। একমাত্র ভগবানই ত্রিগুনাতীত। এ তিনটি গুণ তিনটি পিঠাপিঠি বোনের মত একে অন্যকে সারাক্ষণ জরিয়ে থাকে। এরা ঝগড়া করবে, মারামারি করবে, চুলাচুলি করবে। আবার একজন অন্যজনকে চোখের আড়ালে যেতে দিবে না।তিনবোন একসাথে মজা করে তেঁতুল খাবে। পিঠাপিঠি এ বোন তিনটি কাউকে ছাড়া কেউ একা থাকতে পারে না।প্রত্যেকটি জীব বিশেষ করে মানুষের মধ্যেই এ ত্রিগুণ রয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে:

সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্ ৷৷
তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ৷৷ 
রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্। 
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্মসঙ্গেন দেহিনম্৷৷
তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্বদেহিনাম্। 
প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৪.৫-৮)

"হে মহাবাহো ! সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—প্রকৃতি হতে উৎপন্ন এই তিনটি গুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে শরীরে আবদ্ধ করে। 

হে নিষ্পাপ অর্জুন ! এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল হওয়ায় প্রকাশশীল এবং বিকাররহিত,এই সত্ত্বগুণ আমি সুখী, আমি জ্ঞানী এই অভিমানে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে। 

হে কৌন্তেয় ! রজোগুণ হল রাগাত্মক। এটি কামনা এবং আসক্তি থেকে উৎপন্ন হয়। এ জীবাত্মাকে কর্ম এবং ফলের নিমিত্ত আসক্তি দ্বারা বন্ধন করে। 

হে অর্জুন ! সকল দেহাভিমানীর মোহকারক এই তমোগুণকে অজ্ঞান হতে উৎপন্ন বলে জানবে। এ জীবাত্মাকে প্রমাদ, আলস্য এবং নিদ্রার দ্বারা বন্ধন করে।"

সাধু-সন্তের প্রধান গুণ সত্ত্বগুণ এবং সত্ত্বগুণ থেকে উদ্ভূত লোককল্যাণকামী চিন্তা। সত্ত্বগুণের সাথে সাথে তেমনি তাদের মধ্যে রজোগুণ, তামসিক গুণও রয়েছে। হয়তো কম বেশি থাকতে পারে।সাধুসন্তের ভোগসর্বস্ব অলস থাকার মানসিকতা উৎপন্ন হয় রাজসিক গুণের প্রভাব থেকে। এবং নিজেকে জাহির করা, আত্মপ্রচার, অন্যান্য সাধুসন্তদের প্রতি ঈর্ষা, শিষ্যদের দিয়ে নিজেকে অবতার বলে প্রচার করিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের পদ্মের উপরে বসা বিভিন্ন সংভংচং মার্কা ছবি প্রচার হল তামসিক গুণের লক্ষণ। তেমনিভাবে একজন চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীর মধ্যে তামসিক গুণ তীব্র। সে তামসিকতা সম্পন্ন একজন অধম ব্যক্তি। তিনি যখন রাস্তায় সাধারণ মানুষের সর্বস্ব হরণ করেন, তখন তার মধ্যে তমোগুণে আধিক্য বেড়ে যেয়। সেই তিনিই যখন বাসায় এসে চেয়ারে বসেন, স্ত্রী এসে তাকে জল খাবার দেয় ; তখন মধ্যে কিছুপূর্বের তমোগুণ সংকুচিত হয়ে রজোগুণের আধিক্য বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় যখন তার সন্তান এসে তার কোলে বসে, সে সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করে ; তখন রজোগুণ থেকে ধীরেধীরে সত্ত্বগুণের ভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।অর্থাৎ একজন উত্তম মানব সাধু-সন্ন্যাসীর মধ্যে যেমন তিনটি গুণ আছে, তেমনি চোর, ডাকাত অধমদের মধ্যেও সত্ত্ব, রজঃ, তম এ ত্রিগুণ বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়। তাই কাউকে অধম বলে দূরে সরিয়ে দেয়া নয়, সবাইকেই সংশোধনের সাধ্যমত সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু সুযোগ পেয়েও যদি কেউ সংশোধিত না হয়, তবে বুঝতে হবে ; তার প্রবৃত্তিটাই এমন। সে অধিকারী নয়।

সত্ত্বং সুখে সঞ্জয়তি রজঃ কর্মণি ভারত। 
জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ প্রমাদে সঞ্জয়ত্যুত৷৷
রজস্তমশ্চাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত।
রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং রজস্তথা ॥
সর্বদ্বারেষু দেহেঽস্মিন্ প্রকাশ উপজায়তে। 
জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ্বিবৃদ্ধং সত্ত্বমিত্যুত৷৷
লোভঃ প্রবৃত্তিরারম্ভঃ কর্মণামশমঃ স্পৃহা। 
রজস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে ভরতর্ষভ৷।
অপ্রকাশোঽপ্রবৃত্তিশ্চ প্রমাদো মোহ এব চ। 
তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে কুরুনন্দন৷।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৪.৯-১৩)

"হে অর্জুন ! সত্ত্বগুণ সুখে আসক্ত করে, রজোগুণ

কর্মে এবং তমোগুণ জ্ঞানকে আচ্ছাদিত করে প্রমাদে আসক্ত করে। 

হে ভারত ! রজোগুণ ও তমোগুণকে অভিভূত করে সত্ত্বগুণ প্রবল হয়, সত্ত্বগুণ ও তমোগুণকে অভিভূত করে রজোগুণ প্রবল হয়, তেমনই সত্ত্বগুণ ও রজোগুণকে অভিভূত করে তমোগুণ প্রবল হয়। 

যখন এই দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হয়, তখন সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি হয়েছে বুঝতে হবে। 

হে অর্জুন ! রজোগুণ বৃদ্ধি হলে লোভ, প্রবৃত্তি, স্বার্থবুদ্ধিতে সকামকর্মে প্রবৃত্তি, অশান্তি এবং বিষয়ভোগের লালসা—এই সব উৎপন্ন হয়। 

হে অর্জুন ! তমোগুণ বৃদ্ধি হলে অন্তঃকরণে ও ইন্দ্রিয়ে অপ্রকাশ, কর্তব্য-কর্মে অপ্রবৃত্তি, কর্তব্যের বিস্মৃতি, মোহ বা বুদ্ধির বিপর্যয় —এই সকল উৎপন্ন হয়।"

ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে যেমন ব্রহ্ম আছে, তেমনি প্রত্যেকটি জীব পরিশেষে ব্রহ্মময় হয়েই জন্মজন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্তি লাভ করবে। আমাদের সাত্ত্বিক কর্ম এবং কর্মপ্রচেষ্টাই আমাদের মুক্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই সেই অচিন্ত্যপ্রাণেশ লীলাভরে লীলা করেন।যেহেতু ত্রিগুণ দ্বারা আমরা সবাই আচ্ছন্ন তাই আমরা চাই বা না চাই পাপ আমাদের মোহাচ্ছন্নতা তৈরি করে মুগ্ধ করে।

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন