দক্ষিণ ভারতের একটি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়ায় জীবনের প্রথম পর্যায়ে শ্রীশঙ্করাচার্যের মধ্যে কর্মগত বর্ণাশ্রমের সাথে সাথে জন্মগতভাবে বর্ণাশ্রমের সংস্কারটি ছিল। তাঁর মত মহাভক্ত বৈদান্তিককে জন্মগতভাবে বর্ণাশ্রমের ভেদ থেকে মুক্ত করার জন্যে ভগবান শিব চণ্ডালরূপে তাঁর সামনে প্রকটিত হন। তাঁকে শিক্ষা দেন সকল জীবজগৎ আদতে একই ব্রহ্মের রূপ থেকে রূপান্তর মাত্র ; অর্থাৎ প্রত্যেকটি জীবের মাঝেই একই ব্রহ্ম বিরাজিত। এ পুরো ঘটনাটি আছে শ্রীশঙ্করাচার্যের 'মনীষাপঞ্চকম্' নামক নয়টি শ্লোকের ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটি ক্ষুদ্র হলেও অদ্বৈত বেদান্তদর্শনে অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ।
"একদা সত্যাচার্য (শ্রীশঙ্করাচার্য) মুক্তিপ্রদ কাশীক্ষেত্রে গমন করছেন, পথের মধ্যে ছদ্মবেশ ধারণ করে হরগৌরী আবির্ভূত হলেন। হরপার্বর্তী পথে অন্ত্যজবেশধারী ধারণ করে গমন করছিলেন। চণ্ডালবেশী শ্রীশঙ্করকে দেখে সত্যাচার্য্য বললেন “সরে যাও, সরে যাও। অন্ত্যজবেশধারী ভগবান শ্রীশঙ্কর প্রতুত্তর দিলেন।"
শ্রীশঙ্করাচার্যের মধ্যে যে যৎসামান্য জন্মগতভাবে বর্ণাশ্রমের সংস্কার ছিল; তা ভগবান শিবের দৈবদর্শনে বিদূরিত হয়ে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন:
"তখন ভগবান শ্রীশঙ্কর শ্রীশঙ্করাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আপনি কাকে দূরে চলে যেতে বলছেন? অন্নময় হতে অন্নময়কে এবং চৈতন্য হতে চৈতন্যকে দূর করার কথা বলছেন? আমাকে 'সরে যাও, সরে যাও’ বলছেন কেন?
গঙ্গাজলে যে চন্দ্র প্রতিবিম্বিত হয় এবং একজন চণ্ডালের গৃহের জলাশয়ে সেই একই চন্দ্রমা প্রতিবিম্বিত হয়। এই দুইয়ের মধ্যে কি কোন প্রভেদ আছে? সোনায় নির্মিত ঘটে প্রতিবিম্বত আকাশ এবং মাটিতে নির্মিত আকাশের মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? যিনি নিশ্চল স্বতঃসিদ্ধ আনন্দজ্ঞানের সাগর স্বরূপ, সেই চৈতন্যস্বরূপ প্রত্যকবস্তুতে 'এ ব্রাহ্মণ, এ চণ্ডাল ভেদরূপ ভ্রম আপনার কেন উপস্থিত হচ্ছে?
জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিন অবস্থাতে যে সংবিৎচৈতন্য পরিস্ফুটরূপে প্রকাশিত থাকে। ব্ৰহ্মা হতে পিপীলিকা পৰ্য্যন্ত সমস্ত দেহে যিনি জগৎসাক্ষিণীরূপে অবস্থিত।আমিই সেই সংবিৎস্বরূপ। আমি দৃশ্যবস্তু নই, এমন যার দৃঢ়জ্ঞান রয়েছে, সে চণ্ডালই হোন বা ব্রাহ্মণই হোন– আমি মনে করি সেই ব্যক্তি আমার গুরু।
আমিই ব্রহ্ম, এই অখিল ব্রহ্মাণ্ড চিন্মাত্ররূপে বিস্তৃত, আমা কর্তৃক ত্রিগুণময়ী অবিদ্যা দ্বারা এ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কল্পিত হয়েছে, যে ব্যক্তির এইপ্রকার দৃঢ বুদ্ধি সুখময় নির্মল ব্রহ্মে অটলা থাকে, সে চণ্ডাল বা ব্রাহ্মণ যাই হোক ; সেই আমার গুরু এটাই আমার মত।"
এ অখিল ব্রহ্মাণ্ড নশ্বর। সদগুরুর উপদেশে এই স্থির করে মনকে শান্ত করে নিরন্তর ব্রহ্মধ্যানে রত হতে হবে। এ ব্রহ্মের সাধনজগতে কোন জাতপাতের ভেদাভেদ এই। অধিকারী মাত্রই সে লক্ষ্যে পৌছতে পারবে।যে মুনিগণ একান্ত প্রশান্তচিত্তে ব্রহ্মকে উপলব্ধি করেছেন বা প্রাপ্ত হয়েছেন ; তিনি নিত্য অমৃতের সাগরে বিরাজমান। সেই ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যান। নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিলিত হলে নদীর আলাদা অস্তিত্ব থাকে না ; তেমনি ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি ব্রহ্মের সাথে অভেদ একাকার হয়ে যান।
শশ্বন্নশ্বরমেব বিশ্বমখিলং নিশ্চিত্য বাচা গুরো-
র্নিত্যং ব্রহ্ম নিরন্তরং বিমৃশতা নির্বাজশান্তাত্মনা।
ভূতং ভাবি চ দুষ্কৃতং প্ৰদহতা সংবিস্ময়ে পাবকে
প্রারব্ধায় সমর্পিতং স্ববপুরিত্যেষা মনীষা মম॥
যা তির্য্যঙ্ নরদেবতাভিরহমিত্যন্তঃ স্ফুটা গৃহ্যতে
যদ্ভাসা হৃদয়াক্ষদেহবিষয়া ভান্তি স্বতোঽচেতনাঃ।
তাং ভাষৈঃ পিহিতার্কমণ্ডলনিভাং স্ফুত্তিং সদা ভাবয়ন্।
যোগী নিবৃতমানসো হি গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥
যৎসৌখ্যাম্বুধিলেশলেশতম ইমে শত্রুাদয়ো নিবৃর্তা
যশ্চিত্তে নিতরাং প্রশান্তকলনে লব্ধবা মুনির্নির্বৃতঃ।
যস্মিন্নিত্যসুধাম্বুধৌ গলিতধীর্ব্রহ্মৈব ন ব্রহ্মবিদ্
যঃ কশ্চিৎ স সুরেন্দ্রবন্দিতপদো নূনং মনীষা মম ৷৷
(মনীষাপঞ্চকম্: ৭-৯)
"আমার বুদ্ধি এমন- এ অখিল ব্রহ্মাণ্ড নশ্বর, সদগুরুর উপদেশে সর্বদা এই প্রকার স্থির করে অকপটে শান্তচিত্তে নিরন্তর নিত্যব্রহ্মকে ধ্যানপুরঃসর ভূত, ভবিষ্যতের সমদয় পাপ দগ্ধ করে প্রারন্ধের অগ্নিতে দেহকে সমর্পণ করবে।
দেব, মনুষ্য, তির্য্যগ্জাতি সকলেই যাঁকে সম্যক্রূপে অন্তরে গ্রহণ করেন, যার দীপ্তিতে হৃদয়, ইন্দ্রিয়গ্রাম, দেহ— সমস্ত অচেতনই সমুদ্ভাসিত হয়, সেই সংবিৎকে মেঘাচ্ছন্ন সূর্যমণ্ডল সদৃশী স্ফূর্ত্তিমতী চিন্তা করে যে যোগী প্রশান্তচেতা হন, তিনিই আমার গুরু; এই আমার মনীষা বা দৃঢ় বুদ্ধি।
যে সুখসমুদ্রের কণার কণাপরিমাণ প্রাপ্ত হয়ে ইন্দ্রাদি দেবগণ শান্তিলাভ করেছেন, যে মুনিগণ একান্ত প্রশান্তচিত্তে তাঁকে প্রাপ্ত হয়ে নিবৃতি লাভ করেছেন, নিত্য সুধাসাগরে যাঁর মতি বিগলিত হয়েছে, সেই ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মস্বরূপ। তিনি ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কেউ নয়। তাঁর চরণে দেবরাজও বন্দনা করেন; এই আমার মনীষা বা দৃঢ়বুদ্ধি।"
শ্রীশঙ্করাচার্য মনীষাপঞ্চকম্ গ্রন্থটি ছাড়াও জাতি বর্ণভেদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।
"আমার কোন মৃত্যু নেই, শঙ্কা নেই এবং কোনপ্রকার জাতিভেদ নেই।"
"আমার কোন বর্ণ বা জাতিভেদ নেই, তাই বর্ণাশ্রমবিহিত কোন আচারধর্মের বন্ধনাদিও নেই। আমার ধারণা বা ধ্যানযোগাদিও নেই। আমি আত্মাকে আশ্রয় করে অবস্থিত নই। আমার অধ্যাস বা একবস্তুতে অন্যবস্তুজ্ঞানও নেই। আমি এই সমস্ত হতে অবশিষ্ট একমাত্র অদ্বিতীয় শিবস্বরূপ।"
শ্রীশঙ্করাচার্য কিভাবে সকল মানবকুল নির্বিশেষে কেমন একটি ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিকজাতির কল্পনা করেছেন তার একটি অনন্য উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত 'অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্' নামক গ্রন্থে। এ স্তোত্রের শেষ শ্লোকে তিনি উদাত্তস্বরে বলেছেন, তাঁর মা হলেন জগতের জননী পার্বতী এবং পিতা হলেন জগতের পিতা মহেশ্বর, আর জগতের জনকজননীর সন্তান সকল অর্থাৎ জীবসকল হলো পরমবন্ধু ; স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই হলো তাঁর স্বদেশ।
"জগতের মাতা ভগবতী পার্বতী হলেন আমার মা এবং জগতের পিতা দেব মহেশ্বর হলেন আমার পিতা ; আমার পরম বান্ধব হলেন জগতের পিতামাতার ভক্তগণ এবং স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই আমার স্বদেশ।"
অসাধণ স্যার।অনেকে ভাাবে ভগবান শংকরাচার্য জাতিভেদ করতেন।ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে আজকাল নানা মত হচ্ছে
উত্তরমুছুন