বেদপ্রণিহিতো ধর্মো; শ্রীমদ্ভাগবতে বেদের শ্রেষ্ঠত্ব

বৈদিক জ্ঞানতত্ত্বই শ্রীভাগবতে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের শুরুতেই পরমেশ্বরের বাণী বেদকে একটি একটি কল্পবৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়েছে,আর সেই কল্পবৃক্ষের একটি পাকা টসটসে রসালো ফল বলে অবিহিত  হয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতকে। 'নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং' অর্থাৎ বৈদিক কল্পতরুরূপ জ্ঞানবৃক্ষের পাকা টসটসে রসালো ফল শ্রীমদ্ভাগবত।

কিন্তু বর্তমানে রসালো ফল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে কল্পবৃক্ষকেই অনেকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অস্বীকার করে ফলছে। কিন্তু একথা ভুলেও চিন্তা করছে না যে, অনন্ত বৈদিক জ্ঞানের পরম্পরায় উৎপত্তিলাভ করেছে শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীমদ্ভগবদগীতা।শ্রীমদ্ভাগবত নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন শ্রীমদ্ভাগবতের শুরুতে বলেছে:

ধর্মঃ প্রোজ্ঝিতকৈতবোঽত্র 
পরমো নির্মৎসরাণাং সতাং 
বেদ্যং বাস্তবমত্র বস্তু শিবদং 
তাপত্রয়োন্মূলনম্।
শ্রীমদ্ভাগবতে মহামুনিকৃতে 
কিং বা পরৈরীশ্বরঃ 
সদ্যো হৃদ্যবরুধ্যতেঽত্র কৃতিভিঃ
শুশ্রূষুভিস্তৎক্ষণাৎ ॥
নিগমকল্পতরোর্গলিতং ফলং
শুকমুখাদমৃতদ্রবসংযুতম্।
পিবত ভাগবতং রসমালয়ং
মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১.১. ২-৩ )

"মহামুনি বেদব্যাস-কৃত এই শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে অহংকার শুন্য সাধুপুরুষদের উপযোগী করে ফলাকাঙ্ক্ষারহিত পরমধর্মের কথা বলা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাঝেই ত্রিতাপনাশক পরমসুখকর বস্তুর জ্ঞান নিবদ্ধ আছে। অন্য কোথাও আর এমনটি নেই। তাই সজ্জন ব্যক্তিরা শ্রীমদ্ভাগবতে সদা মনোনিবেশ করলে শ্রীভগবান তাদের নিকটে সহজেই ধরা দেন।

বেদপ্রণিহিতো ধর্মো, শ্রীমদ্ভাগবত, Vedas, বেদ, পবিত্র বেদ

ওগো পৃথিবীর রসিক- ভাবুক মানুষেরা, বেদ যেন এক কল্পতরু (এমন একটি বৃক্ষ, তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়) ; তা থেকে উদ্ভূত এই ভাগবত-ফল শুকদেবের শ্রীমুখে পড়ে অমৃতরসে সিক্ত হয়ে ওঠে। তারপর সেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই শ্রীমদ্ভাগবত রস তোমরা ব্রহ্মে লীন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম আস্বাদন করে চলো।এই রস কেবলমাত্র মর্ত্যভূমিতেই সুলভ।"

 দুঃখজনক হলেও সত্য, ইদানীং কিছু ভাগবত পাঠকেরা বিভিন্ন স্থানে ভাগবত পাঠের আসরে অযাচিতভাবে অজ্ঞানতাবশত অনেকেই বলে, কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ। আমি ঠিক জানিনা, তারা এই কথাগুলি বুঝে বলে, নাকি না বুঝে বলে? অথচ শ্রীমদ্ভাগবতে বেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে:

যস্ত্বিহ বৈ নিজবেদপথাদনাপদ্যপগতঃ
পাখণ্ডং চোপগতস্তমসিপত্রবনং প্রবেশ্য

কশয়া প্রহরন্তি তত্র হাসাবিতস্ততো ধাবমান উভয়তোধারৈস্তালবনাসিপত্রৈশ্ছিদ্যমানসর্বাঙ্গো হা হতোঽস্মীতি পরময়া বেদনয়া মূৰ্চ্ছিতঃ পদে পদে নিপততি স্বধর্মহা পাখণ্ডানুগতং ফলং ভুঙক্তে।।

(শ্রীমদ্ভাগবত: ৫.২৬.১৫)

"যে ব্যক্তি অকারণে বেদাচার ছেড়ে পাষণ্ড ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে অনাচারে প্রবৃত্ত হয়, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নরকে নিক্ষেপ করে গিয়ে কশাঘাত করতে থাকে। সেই কশাঘাত খেয়ে ভয়ংকর যন্ত্রণায় ছুটে পালাতে গেলে দুপাশে তালবনের অসিপত্রে, অর্থাৎ তলোয়ারের মতো ধারাল পাতায় সেই পাপির সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। সে তখন 'হা হতো অস্মি' ( হায় হায় আমি মরলাম! ) বলে দারুণ মৃত্যু যন্ত্রণায় পদে পদে জ্ঞান হারায়। স্বধর্ম ত্যাগ করে পাষণ্ড ধর্ম অনুসরণ করলে এমন শাস্তিই ভোগ করতে হয়।"

যমদূতা উচুঃ
বেদপ্রণিহিতো ধর্মো হ্যধর্মস্তদ্বিপর্যয়ঃ।
বেদো নারায়ণঃ সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভূরিতি শুশ্রুম৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৬.১.৪০)

"যমদূতেরা বললেন, বেদে যা কর্তব্য বলে বলা আছে একমাত্র তাই ধর্ম, এর বিপরীত যা অর্থাৎ বেদে যা নিষিদ্ধ তা সকলই অধর্ম। বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণের নিঃশ্বাস থেকে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছে, তাই বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণ এবং স্বয়ম্ভূ।"

শ্রীমদ্ভাগবতে  বেদ সম্পর্কে জাজ্বল্যমান তথ্যসূত্র দেখেও, কিছু ব্যক্তি না বুঝে বলে, কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ এবং পুরাণই সব।তাদের উদ্দেশ্যে একটি ছোট্ট প্রশ্ন। কলিযুগে যে বেদ নিষিদ্ধ এ বিষয়টি কি বেদে কোথাও ভগবান বলেছেন? না ভগবান এমন কথা বলেননি। তাহলে কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধের কথাগুলি কোথায় আছে বা সমাজে আসলো কোথা থেকে?

বিষয়টি একটি লক্ষ-কোটি টাকার প্রশ্ন। তবে শাস্ত্রে কোথাও না থাকলেও, বিষয়টি রয়েছে বিভিন্ন গুরু, তথাকথিত অবতার, ধর্মব্যবসায়ী এবং কিছু পেশাজীবী গীতা-ভাগবত পাঠকদের মস্তিষ্কে ও তাদের নিজস্ব গ্রন্থে। আমার একবার মনে আছে নারায়ণগঞ্জে একবার শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ শুনছিলাম। পাঠক যে কোথা থেকে কি বলছিলেন, তাই কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তিনি তার আসনে বসে গ্রন্থটিকে মেলে ধরে চোখ বুঝলেন। চোখে বুঝে মনে হল তিনি, রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্যচরিতামৃত কিছুই আর বাদ রাখলেন না। খুশি মত তার মনে যা আসলো, তাই মনের মাধুরি মিশিয়ে অনর্গল বলেই গেলেন। তিনি যে কি বুঝাতে চাইলেন, তাই ঠিক বুঝতে পারলাম না।

শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন