প্রাচীন দ্বারকার ইতিহাস: রহস্য, পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক সত্যের মেলবন্ধন

গুজরাটের সমুদ্রতীরে অবস্থিত দ্বারকা শহর কেবল তার মনোরম সৈকত ও মন্দিরের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্যও বিখ্যাত। পুরাণ অনুসারে, দ্বারকা ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের রাজধানী এবং দ্বাপর যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই প্রবন্ধে আমরা প্রাচীন দ্বারকার ইতিহাস, তার পৌরাণিক কাহিনী, ঐতিহাসিক প্রমাণ, ধর্মীয় গুরুত্ব, এবং আধুনিক দ্বারকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

দ্বারকার ইতিহাস, প্রাচীন দ্বারকার ইতিহাস, সাগরতলের দ্বারকার ইতিহাস

পৌরাণিক কাহিনী:

মহাভারত অনুসারে, যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করেন, তখন তিনি যাদবদের একটি নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন। সমুদ্রদেবতা তাঁকে সমুদ্রের গভীরে নিজের বাসস্থান থেকে ৫৬০০০ যোজন জমি উপহার দেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বকর্মাকে এই জমিতে একটি নগরী নির্মাণ করার আদেশ দেন। বিশ্বকর্মা ৭ দিনের মধ্যে দ্বারকা নগরী নির্মাণ করেন, যা স্বর্গের চেয়েও সুন্দর ছিল। শহরের নামের আক্ষরিক অর্থ হল প্রবেশদ্বার। দ্বারকাকে ইতিহাস জুড়ে "মোক্ষপুরী", "দ্বারকামতি" এবং "দ্বারকাবতী" নামেও উল্লেখ করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক প্রমাণ:

পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি দ্বারকাকে ৫ম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর হিসেবে নির্দেশ করে। শহরটি সম্ভবত সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার সাথে বাণিজ্য করত এবং মেসোপটেমিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের সাথেও সম্পর্ক ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে, মৌর্য সাম্রাজ্য দ্বারকাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর, শহরটি গুপ্ত,  চালুক্য, এবং রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছিল।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে দ্বারকার দ্বারকাধীশ জগৎ মন্দিরের কাছে একটি বাড়ি ভাঙার সময় মন্দির চূড়ার সন্ধান মেলে। এরপর এই খননকার্যের দায়িত্ব নেয় পুণের ডেকান কলেজ। নবম শতাব্দীর বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায় খননকার্যের পর। তাছাড়াও অন্যান্য জায়গাতেও মেলে আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। বিজ্ঞানীদের অনুমান, দ্বারকা একাধিকবার ধ্বংস হয়েছিল। যদিও স্থানীয়দের বিশ্বাস, দ্বারকাকে ছ'বার সমুদ্র গ্রাস করেছে। বর্তমান দ্বারকা হল সপ্তম দ্বারকা।


ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ বিভাগের প্রাক্তন মহাপরিচালক এবং প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শিকারিপুর রঙ্গনাথ রাও কর্নাটকের বাসিন্দা হলেও গুজরাতেও রয়েছে তাঁর বসত। গুজরাতেই তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওশানোগ্রাফির হয়ে জলের নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।


১৯৮৯ সালের দিকে অনুসন্ধানের সময়, সমুদ্রের ঘাস এবং বালির নীচে আয়তক্ষেত্রাকার পাথর পাওয়া গিয়েছিল। গবেষকদের মতে এটি একটি কাঠামোর অংশ। এ ছাড়াও কিছু অর্ধবৃত্তাকার পাথর পাওয়া যায়। সন্ধান মেলে চুনাপাথরের প্রমাণ সাইজের নোঙরের। মজার ব্যাপার, ছেনি দিয়ে গর্ত করা নোঙরটি। বহু শতাব্দী ধরে আশপাশের এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত এই চুনাপাথর। আন্তঃলক বা কাঠ ভরাটের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এই পাথর বলে গবেষক তথা সমুদ্র বিজ্ঞানীদের ধারণা। পাওয়া যায় মৃৎপাত্র, গয়না ও মুদ্রাও। ওমান, বাহরাইন এবং মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ইরাকেও এই ধরনের মুদ্রার সন্ধান মেলে। ২০০৭ সালের সার্ভের আগে, সমুদ্রের দুই নটিক্যাল মাইল মারফত এক নটিক্যাল মাইল এলাকায় একটি হাইড্রোগ্রাফিক নিরীক্ষা করা হয়। এর ভিত্তিতেই জলপ্রবাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।


২০০ বর্গ মিটার এলাকা নির্ধারিত হয় এই তথ্যের বনিয়াদে (গ্রাফ অনুসারে উল্লম্ব এবং অনুভূমিক রেখায় চিত্রিত)। অবশেষে চিহ্নিতকরণের ভিত্তিতে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় সার্ভে হয়। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর অলোক ত্রিপাঠী একবার বিবিসিকে বলেছিলেন, 'এর পরে, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে বিভাগ আরেকটি খনন পরিচালনা করে। খননকার্যের পর কিছু জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। মনে করা হয়, সেসব ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তাছাড়াও দ্বারকার চারপাশে খননের সময় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষও পাওয়া যায়।’


তাঁর মতে, '৫০০টিরও বেশি জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই বস্তুর কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে, কীভাবে এখানকার সংস্কৃতি পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছিল। অনুসন্ধানের পর যেসব মৃৎপাত্র বা পাথরের সামগ্রী পাওয়া যায়, তা আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে সমুদ্রের যে অংশে স্রোত বেশি, সেখানে মাটির পাত্রের খোঁজ মেলেনি।’


সমুদ্রপৃষ্ঠের ঐতিহাসিক উত্থান-পতন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে, সিএসআইআর-এনআইও'র (CSIR-NIO) প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী ড. রাজীব নিগম বলেন, 'প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনকার তুলনায় ১০০ মিটার কম ছিল। এর পরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার স্তর আবার কিছুটা বাড়ে। ৭,০০০ বছর আগে সমুদ্রের স্তর আজকের চেয়ে বেশি ছিল। প্রায় ৩৫০০ বছর আগে এই উচ্চতা আবার হ্রাস পায়। সেই সময় দ্বারকা শহরটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে সমুদ্রের উচ্চতা আবার বাড়তে শুরু করে এবং শহরটি ডুবে যায়।’


দ্বারকার 'সার্চ প্লেস'-এ জোয়ারের আন্ডারকারেন্টের কারণে শুধুমাত্র ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে জলে ডুব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। যেহেতু দেশে এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সংখ্যা খুবই কম, তাই গবেষণাটি ধীরে ধীরে এগিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ (বর্তমানে এএসআই থেকে অবসরপ্রাপ্ত) কে. কে মহম্মদ মনে করেন, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সংস্থান এখনো এ দেশে নেই।


পশ্চিম সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সান্তোরিন (গ্রিস), অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপ 'ডুব শহর'-এর কথা প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা মনে করেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে একটি বিশাল এলাকা তলিয়ে গেছে। এ নিয়ে অনেক কিংবদন্তিও রয়েছে। এমনই একটি বিশ্বাস তামিলনাড়ুর কাছে মহাবালিপুরমেও প্রচলিত। ২০০৪ সালের সুনামির সময় এটির কিছু অংশ সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে বলে জানা যায়।

দ্বারকাধীশ মন্দির:

দ্বারকার কেন্দ্রবিন্দু হল দ্বারকাধীশ মন্দির, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উৎসর্গীকৃত একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটি ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং ৫ স্তর উঁচু,৭২ ফুট লম্বা এবং ৫০ ফুট চওড়া। মন্দিরের শীর্ষে একটি সোনালী ধ্বজ রয়েছে, যা ১৫০ ফুট উঁচু। মন্দিরের নির্মাণশৈলী হিন্দু স্থাপত্যের চূড়ান্ত নিদর্শন।

ধর্মীয় গুরুত্ব:

দ্বারকা হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থস্থান। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে মৃত্যুর আগে অন্তত একবার দ্বারকা ভ্রমণ করা উচিত। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী এই শহরে আসেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁর আশীর্বাদ লাভ করতে। প্রাচীন দ্বারকা বর্তমানে যেখানেই থাকুক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মত তাঁর বাসস্থানের প্রতি বিশ্বের সকল সনাতনীদের শ্রদ্ধা অটুট থাকবে।

তথ্যসূত্র- prohor.in, মহাভারত ও উইকিপিডিয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন